সাইফুল হক মোল্লা দুলু : বিয়েটা এত সহজ ছিল না তাদের। রাজনীতি করা বোহেমিয়ান ছেলের সঙ্গে কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না মামা-খালারা। কিন্তু তাদের মন যে সবার অন্তরালে বাঁধা পড়ে গেছে একে অপরে- সব প্রগাঢ়তায়। তাই পরিবারের সব চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। উভয় পরিবারের সম্মতি নিয়ে তারা হয়ে ওঠেন আদর্শ স্বামী-স্ত্রী- মো. আবদুল হামিদ আর রাশিদা হামিদ। আজ তাদের ৫৫তম বিয়েবার্ষিকী।
‘এইচএসসি পড়ার সময়েই ১৯৬৪ সালের ৪ অক্টোবরে বিয়ে! মামা বিয়েতে মত বদলে ফেলতে পারেন। এ জন্য এত তাড়াহুড়া। স্বামী রাজনীতি করেন। কিশোরগঞ্জে একটি ছোট বাসায় থাকতাম। গ্রামের বাড়ি থেকে ছোট ছোট অনেক দেবর আর ভাগ্নে আসে বাসায়। লেখাপড়া করে এখান থেকে। তাদের কেউ পঞ্চম শ্রেণিতে, কেউ ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সারাদিন বাসায় লোকজন। তাদের চা-নাশতা দেওয়া, পরিবারের লোকজনের জন্য রান্না, খাওয়ানো সব সামলাতে হতো আমাকেই।’
‘তারপর কেটে গেছে ৫৫ বছর।’
রাশিদা হামিদের চোখে ভাবালুতা, মধুর স্মৃতিকাতরতাও, ‘বিয়ের পর হঠাৎ এমন অবস্থায় পড়লাম, কোনো অবসর ছিল না। নিজের দিকে খেয়াল রাখার সুযোগ ছিল না। টানাপড়েনের সংসার। দিনে দিনে সংসার বড় হতে থাকে। ছন্দপতন ঘটে নিজের লেখাপড়ার। তারপরও হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাই। গভীর রাতে একটু একটু করে পড়ি। এভাবেই এইচএসসি। স্বামী আর বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজের জীবন নিয়ে কোনো চিন্তার সুযোগ পাইনি। তবে আমার স্বামী মানুষকে ভালোবাসেন। তিনি অতিশয় সহজিয়া ও সৎ রাজনীতিক। এ জন্য তিনি যে একদিন ভালো করবেন- এ বিশ্বাস সব সময় ছিল আমার।’
‘তার পর?’
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে আমাকে। ডাকাতরা কেড়ে নেয় সবকিছু। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তানদের মুখে সময়মতো খাবার তুলে দিতে পারিনি। মেলেনি প্রয়োজনীয় কাপড়। তবে থেমে থাকিনি। স্বামীকে রাজনীতির কারণে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। থেমে থাকিনি তখনও।’
‘এত দিন পর কেমন মনে হচ্ছে?’
‘স্বামী জাতীয় সংসদ সদস্য হয়েছেন সাতবার। সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা, ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরপর দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের। কারণ আমাদের প্রেমের বিয়েতে পরিবারের কারও কারও অমত ছিল। পরে তারা সবাই আমাদের দু’জনের সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করে মেনে নেন বিয়েটা। সেই থেকে দু’জন একসঙ্গে, একপথে দীর্ঘ ৫৫টি বছর।’
‘ভালোবাসার শুরুটা কখন?’
‘কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হই। ওই কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস তখন মো. আবদুল হামিদ। পরিচয় হয় তার সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম। তার পর বিয়ে।’
‘এখন কেমন মনে হয় স্বামীকে?’
‘এখনও সেই আগের মতোই আছেন তিনি। সংসার জীবন শুরু করেছিলাম এক কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। তখন রাত দেড়টা-দুটোর আগে ঘুমাতে পারতাম না। এখনও রাত দুটোর আগে ঘুমাতে পারি না।’ হাসতে হাসতে বলেন রাশিদা বেগম, ‘তাকে কতটা ভালোবাসি, তা কেবল আমিই জানি।’
‘মানুষটাকে ভালোবাসার কারণ?’
‘কারণ তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। কারও ক্ষতি করেন না। তার সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখনও বঙ্গভবনে লুঙ্গি পরে এলাকার কোনো সাধারণ মানুষ এলে সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে পড়েন। এ সরলতার জন্যই মানুষটিকে এত বেশি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।’
‘কেমন চলছে এখনকার সংসার?’
‘তিন পুত্র ও এক কন্যার মা হয়েছি। মাঠের রাজনীতি করতে গিয়ে আজকের রাষ্ট্রপতি কখনোই ঘর-সংসার কিংবা স্ত্রী-পুত্রের খবর রাখতে পারেননি। একান্ত প্রয়োজনেও পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে পারেননি। সব সময় থেকেছেন গণমানুষের সঙ্গে। মানুষই যেন তার কাছে সব; মানুষের ঘরই যেন তার ঘর, তার সংসার। জনমানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে ভুলে যেতেন নিজের ঘরের কথা, সংসারের কথা; এমনকি স্ত্রী-পুত্রের কথাও। এসব নিয়ে কোনোদিন অনুযোগ কিংবা অভিমান করিনি। সবকিছু মেনে নিয়েই এই তো; কেটে গেল এতটা বছর!’