তোফায়েল আহমেদ তুষার : আজ থেকে ১৬ বছর আগে এমনই একটি সকাল এসেছিলো। তারিখটা ২০০৩ সালের ২১ এপ্রিল, ৭ বৈশাখ, সোমবার। প্রতিদিনের মতোই দিনটি এসেছিলো অষ্টগ্রাম বাসীর জীবনে। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস, কখনও রোদ, কখনও ছায়ার খেলা। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তেমনি কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার নাথ পাড়া এলাকার বিশিষ্ট কাপড় ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ দেবনাথের বাড়িতে তখন তাঁরই ছোট ভাই জগদীশ চন্দ্র দেবনাথের বিয়ের বরযাত্রার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। ঢাকা, কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অতিথিদের সমাগমে ভরেছিলো নাথ পাড়া। বরযাত্রা যাবে কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলায়।
ভাটি এলাকা হওয়ায় তখন অষ্টগ্রামের মূল যাতায়াতের মাধ্যম লঞ্চ বা নৌকা। তাই জগদীশের বিয়েতে বরযাত্রার জন্য ভাড়া করা হয় এমভি মজলিশপুর নামের একটি লঞ্চ। যেটি প্রতিদিন অষ্টগ্রাম টু ভৈরব যাতায়াত করে। যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে লগ্ন বা সময় বলে একটা কথা আছে। বরযাত্রার লগ্নেই বর ও কার আত্মীয়-স্বজন সহ প্রায় শতাধিক বরযাত্রী নিয়ে অষ্টগ্রাম লঞ্চ ঘাট থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার আশুগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে রাক্ষুষে এমভি মজলিশপুর লঞ্চটি। বিয়ের যাত্রা আনন্দেরই হবার কথা। এলাকার লোকজন লঞ্চটিকে বিদায়ও জানায় ঘাট থেকে। এ বিদায় যে শেষ বিদায় হবে তা তো ছিলো সবারই অজানা।
অষ্টগ্রাম উপজেলার সবাই যার যার অবস্থান থেকে ছিলো কর্মব্যাস্ত। হঠাৎ বিকাল আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে খবর ভৈরবে লঞ্চ ডুবেছে। খবর শুনে অনেকই বুঝতে পারছে না কোন লঞ্চটি মেঘনার গভীরে তলিয়ে গেছে। ২০০৩ সালে মোবাইল ফোন ততো টা সচরাচর নেই সবার হাতে। উড়ো উড়ো খবরে শেষ পর্যন্ত খবর এলো শতাধিক যাত্রী নিয়ে অষ্টগ্রামের বরযাত্রীবাহী এমভি মজলিশপুর নামক লঞ্চটি ঝড়ের কবলে পরে মেঘনার পেটে চলে গেছে।
চারদিকে শুরু হলো বরযাত্রার যাত্রীদের স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাদ। প্রিয় মুখটি কি ফিরবে আবার? নাকি নিরব, নিথর অর্ধগলিত হয়ে ফিরবে সেই প্রিয়জন? যে যেভাবে পারেন সাথে সাথেই ছুটে গিয়েছেন দূর্ঘটনা কবলিত স্থানে। কেউ কেউ বেঁচে ফিরেছেন অলৌকিকভাবে। বেঁচে ফিরে বর্ণনা দিলেন সেই বিভিষীকাময় সময়টির কথা। মেঘনায় হঠাৎ বাতাসের তীব্রতা, নদীর ঢেউ ফুলে ফেঁপে ভয়ানক রূপ নিয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম আঘাতে আশুগঞ্জের পানিশ্বর নামক স্থানে ঝড়ের কবলে পড়ে সেই রাক্ষুসে লঞ্চটি।
লঞ্চের সারেং জালাল মিয়া নদীর গর্জনে টের পেয়ে গিয়েছিলেন অবস্থা ভালো না। লঞ্চ নিরাপদ স্থানে নিতে হবে। প্রচন্ড ঢেউ আর বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে নদীর পাড়ে লঞ্চটিকে নিরাপদেই ভিড়াতে পেরেছিলেন। নোঙ্গরও করেছিলেন। মেঘনার ঝড় কি এতোই শান্ত? না হঠাৎই আরেকটি দমকা হাওয়া এসে শেষ করে দিলো সব। নোঙ্গরের দড়ি ছিড়ে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে লঞ্চ আবার নদীতে। দুই তিনটা দোল দিয়েই আস্তে আস্তে তলিয়ে গেলো এমভি মজলিশপুর। কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে নদীতে ঝাপ দিয়ে বেঁচে ফিরলেও হারিয়েছেন আপন স্বজনদের।
এত প্রাণ হারায় বর জগদীশ, বিশ্ব দাস, পলাশ, দিপ্তী, শিপন, সজল, সোহাগ, সঞ্জয়, মূছা মিয়া, জহির, কবি চারুনাথ, সারেং জালালসহ ৫৭ টি তাজা প্রাণ। সেদিনের ঘটনায় যেন অষ্টগ্রাম লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। স্বজনহারাদের আহাজারি আর আর্তনাদে আকাশ-বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিলো। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় যে মৃত্যুটি তা হলো অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চাকুরীজীবি জহির চাচার মৃত্যুটি। তার পরিবারে স্ত্রী আর এক মেয়ে। ১৯ এপ্রিল ২০১৩ সালে সন্ধ্যায় তার পরিবারে আসে আরেক নতুন সদস্য। তার বাড়ি খুব সম্ভবত মুন্সিগঞ্জ জেলায় ছিলো। সদ্য জন্ম নেয়া ছেলেকে দেখার উদ্দেশ্যে সকালে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেও সময় সংকীর্ণতার কারনের সকালের লঞ্চটি ধরতে তিনি ব্যার্থ হন। পরে আর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে বিয়ের বরযাত্রীর লঞ্চে করেই দুপুরে রওনা হন বাড়ির উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত প্রিয় ছেলের মুখটি আর দেখে যেতে পারেন নি জহির সাহেব। ছেলেরও বাবাকে দেখা হয়ে উঠেনি।
এ ঘটনা কেড়ে নিয়েছিলো অষ্টগ্রামবাসীর মুখের ভাষা চোখের ঘুম। আজো মনে পড়ে সেদিনের ঘটনা। চোখের কোনে জমে অশ্রু আর বুক ভরা বেদনা। আজকের এই দিনে সেই সকল বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।