সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / ফিচার / শিল্প ও সাহিত্য / বঙ্গবন্ধুর বৃক্ষপ্রেম ও বনায়ন ভাবনা

বঙ্গবন্ধুর বৃক্ষপ্রেম ও বনায়ন ভাবনা

জাকারিয়া মন্ডল: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃতিপ্রেম ছিল সীমাহীন। টুঙ্গিপাড়ায় দুরন্ত শৈশবে হিজলের ডাল থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়া ছিল তাঁর শখের খেলা। বাবার সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরে থাকাকালে মাঠের পাশের আমগাছের নিচে আড্ডা জমাতেন বন্ধুদের নিয়ে। ওই আমগাছ ছিল তাঁর বক্তৃতা শেখার মঞ্চ। রাজনৈতিক কারণে বারবার কারাবরণ করতে গিয়ে তাঁর এই প্রকৃতিপ্রেম আরও গভীর রূপ নেয়।

কারাজীবনে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন, নিজের ওয়ার্ড বা সেলের সামনে ফুলের বাগান গড়েছেন বঙ্গবন্ধু। নিজের হাতে মাটি কুপিয়েছেন। ছেঁটেছেন আগাছা, বাদলা ঘাস। নিজের বাগানের পরগাছার সঙ্গে কখনও কখনও পথভ্রষ্ট রাজনীতিকের মিল খুঁজে পেয়েছেন জাতির জনক। কখনও বিভোর হয়েছেন ফুলের সুবাসে। বাগানের রূপে মগ্ন হয়ে ভুলে থেকেছেন কারাজীবনের যন্ত্রণা।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে নিরাপত্তা আইনে তৃতীয়বার জেলে যান বঙ্গবন্ধু। তাঁকে যেখানে রাখা হয় সেখানে কোনো ফুলের বাগান ছিল না। জমাদার সিপাহিদের দিয়ে ওয়ার্ড থেকে ফুলের গাছ আনান বঙ্গবন্ধু। বাগান করেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকও তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলে। সদ্য বিয়ে করেছেন। বেগম যেদিন তাঁকে দেখতে আসতেন, নিজের বাগানের ফুল তুলে হয় মালা, নয়তো তোড়া বানিয়ে উপহার দিতেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৫০ সালে তাঁকে ফরিদপুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলে কারা হাসপাতালের সামনে একটা ফুলের বাগান পান বঙ্গবন্ধু। স্বেচ্ছায় নেন বাগানটাকে আরও ভালো করার দায়িত্ব।

কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘লাউয়ের গাছ লাগাইয়াছিলাম। গাছ হয়েছে। ঝিংগার গাছও বেড়ে উঠেছে। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি। বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে।’ ওই মাসেরই ১৬ জুন তাঁকে সেলে নিয়ে গেলে তিনি লেখেন, ‘শুধু সুবিধা হলো ঘরটার সামনে কিছু জায়গা আছে। গাছ-গাছালি আছে বলে ফুলের ও ফলের বাগান করতে পারি।’

তারপর ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না।’ এর দুদিন পর ২৫ জুন তিনি লেখেন, ‘একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি।’

কিন্তু বাগানের বাজে গাছগুলো কখনও কখনও পথভ্রষ্ট রাজনীতিকের প্রতীকী রূপ হয়ে ধরা দেয় আজন্ম দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর চোখে। ১৯৬৬ সালেরই ২১ জুন তিনি লেখেন, ‘যে পরগাছা চোখে পড়ে তাকেই ধ্বংস করি।’ ২৩ জুনের বর্ণনায় তিনি আরও লেখেন, ‘এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রজনীতিবিদ– যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়।’

একই বছরের ৯ জুলাই সকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর দূর্বা কাটায় কথা জানা যায় কারাগারের রোজনামচায়। ১৭ জুলাই তিনি লেখেন, ‘বাদলা ঘাসগুলি আমার দূর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিয়েছে। কত যে তুলে ফেললাম। তুলেও শেষ করতে পারছি না। আমিও নাছোড়বান্দা। অনেক তুললাম আজ।’
তাঁর বাগানে নিজের হাতের গাছে যখন ফুল ফোটে, তার গন্ধে বিমোহিত হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৬ সালেরই ২৪ জুন তিনি লেখেন, ‘আমার ঘরের দরজার পাশে একটা কামিনী ও একটা শেফালী গাছ। কামিনী যখন ফুল দেয় আমার ঘরটা গন্ধে ভরে থাকে। একটু দূরেই দুইটা আম আর একটা লেবু গাছ। বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন আরও সবুজ, আরও সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ভালো লাগলো দেখতে। মাঠটা সবুজ দূর্বায় ভরে উঠেছে। তারপর গাছগুলি, বড় ভাল লাগলো। বাইরেই যেয়ে বসলাম। দেখলাম এদের প্রাণ ভরে। মনে হল যেন নতুন রূপ নিয়েছে।’

এই রূপ আর সুবাসের ভেতরেই কষ্ট বিসর্জন দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৭ সালের ১২-১৩ এপ্রিল তিনি লেখেন, ‘সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি, তখন রাতের কষ্টের কথা ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়।’

বঙ্গবন্ধুর এই বৃক্ষপ্রেম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরও বৃহত্তর পরিসরে বিকশিত হতে থাকে। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে।’

বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তৃতায় পাকিস্তান আমলের স্মৃতিচারণে শাসকদের প্রতি সুন্দরবনকে রক্ষার আহ্বান প্রকাশ পায়।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাছ লাগিয়ে ঘোড়দৌড়ের ময়দানকে পরিণত করা হয় সুদৃশ্য উদ্যানে। নাম রাখা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

রেসকোর্সকে উদ্যানে পরিণত করার সময়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ডাকেন বঙ্গবন্ধু। তাদের বলেন, ‘রেসিং ট্র্যাকের ওপর সারি বেঁধে নারকেল গাছ লাগাও।’

এ কথা শুনে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফলের গাছ লাগালে লোকজন তো সেই ফল চুরি করে খেয়ে নেবে।’

বঙ্গবন্ধু হেসে বলেন, ‘জনগণের জমি, জনগণের গাছ। ওরাই যদি ফল খায়, আপনার-আমার আপত্তি কোথায়?’

মূলত স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বৃক্ষরোপণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে গণভবন, বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগান বঙ্গবন্ধু।
যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বৃক্ষসম্পদের ঘাটতি পোষাতে দেশজুড়ে শুরু করেন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।

১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৃক্ষরোপণ অভিযান উদ্বোধনে দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দেশের জনপ্রতিনিধি, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সমাজসেবী ও আপামর জনসাধারণের কাছে আবেদন করছি, তারা যেন নিজেদের এলাকায়– স্কুল, কলেজ, কলকারখানা, রাস্তাঘাট এবং বাড়িঘরের আশপাশে যেখানেই সম্ভব মূল্যবান গাছ লাগিয়ে এবং তার পরিচর্যা করে সরকারের এ প্রচেষ্টাকে সফল করে।’ এমএ হাসান সম্পাদিত বঙ্গবন্ধুর প্রবন্ধ সংকলন আমার কিছু কথা গ্রন্থেও বৃক্ষ ও বন বিষয়ে জাতির জনকের দূরদর্শী ভাবনা ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অতি সত্বর বন জরিপ ও বন সংরক্ষণ প্রণালী নির্ধারণ করতে হবে। নতুন নতুন বন সৃষ্টি করার পরিকল্পনা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।’

মাঠ পর্যায়ে উদ্ভিদ বিষয়ক জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে উদ্ভিদ বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, নমুনা সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেনিয়াম।

বাড়ির আনাচে-কানাচে ও পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণের আহ্বান জানান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর হাতেই সূচিত হওয়া উপকূলীয় বনায়ন এখন সারা বিশ্বেই মডেল হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর যথানিয়মে পালিত হচ্ছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। দেশজুড়ে বৃক্ষপ্রেমী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। রোড ডিভাইডারে মাথা তুলছে নানা প্রজাতির ফল ও ফুলের গাছ। অনেকের ছাদ আর বারান্দা হয়ে উঠছে সবুজ। ঘরের ভেতরও সবুজায়নের চর্চা করছে মানুষ। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী এক কোটি চারা রোপণ ও বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের জুনে গণভবন প্রাঙ্গণে রোপণ করেছেন চালতা, ছাতিম ও তেঁতুল চারা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও বৃক্ষরোপণের প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সব কিছুর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত সেই হিজল আর আমগাছ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নারিকেল গাছের মতো খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর রোপিত নারিকেল গাছটিও আজ ফলবতী। ওসব বৃক্ষ আজও রোদে পোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজে। গায়ে মাখে ভরা পূর্ণিমার মায়াবী জোছনা। বাতাসে শাখা দুলিয়ে ছড়ায় বঙ্গবন্ধুরই মহিমা।

ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও গবেষক, তথ্যচিত্র নির্মাতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *