নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ: সোহেল রানা। একজন ফায়ারম্যান। গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকন্ডের সময় নিজের জীবন বাজি রেখে বিপদগ্রস্ত মানুষের জীবন বাঁচাতে লড়াই করছিলেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় অনেকের জীবন বাঁচে। এক সময় নিয়ন্ত্রনে আসে আকাশস্পর্শি (!) আগুনের শিখা। তবে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে নিভে যায় নিজের জীবন প্রদীপ।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামের দরিদ্র কৃষক নূরুল ইসলাম ও মোছা হালিমা খাতুনের ৪ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সোহেল রানা ছিলেন সবার বড়। মাত্র তিন বছর আগে ফায়ার সার্ভিসে ফায়ারম্যান হিসেবে চাকুরি নেন তিনি। নিজের ও পরিবারের জন্য দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন সোহেল রানা। তবে স্বপ্ন ছিল- একদিন পরিবারের দু:খ্য-কষ্টগুলোকে বিদায় জানাবেন নিজের প্রচেষ্টায়। ছোট ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়ে তারচেয়ে অনেক বড় পদে চাকুরি করাবেন। স্বপ্ন ছিল, বাড়ির জরাজীর্ণ পুরনো টিনের ঘরটিকেও বিদায় জানাবেন। সেখানে উঠবে নতুন ঘর। দুখিনি মায়ের মুখে হাসি ফুটবে। বাড়িতে উঠবে নতুন ঘর। এরপর সংসারে সাজাবেন। বিয়ে বরবেন। কিন্তু এসব এখন স্বজনদের কাছে কেবলই দু:স্বপ্ন।
সবশেষ গত ২৩ মার্চ বাড়ি এসেছিলেন সোহেল রানা। সেদিন ঢাকায় যাওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন, ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে খুব শিঘ্র বাড়ি আসবেন। তবে এবার তিনি জীবন থেকেই নিলেন-লম্বা ছুটি। তাইতো প্রিয় সন্তানের মৃত্যু খবরে বুক চাপড়ে মাতম করছেন তার মা-বাসহ স্বজনরা।
সোহেলের মৃত্যু খবরে এখন স্বজনদের চোখে শুধুই কান্না। কিশোরগঞ্জের কেরুয়ালা গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বার বার মুর্চ্ছা যাচ্ছিলেন, সোহেলের মা হালিমা খাতুন। এ দিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যাক্তিকে হারিয়ে বিপদের মুখে পড়েছে পরিবারটি। মৃত্যুর খবর পেয়ে সোহেল রানাদের বাড়িতে ভিড় করছে স্বজনেরা। চারদিকে যেনো কান্নার রোল। কে কাকে শান্তনা দেবে। এমন করুন মৃত্যুযে মেনে নিতে পারছেনা কেউ। প্রিয় বুকের ধন চলে গেছে না ফেরার দেশে। তাইতো কিছুতেই কান্না থামছেনা সোহেল রানার মা হালিমা খাতুনের। চারদিকে কান্নার রোল। কে কাকে শান্তনা দিবে!
গতকাল সোমবার সকালে সিঙ্গাপুর থেকে সোহেলের মৃত্যুর খবর আসে। গতকাল সেখানে গেলে হঠাৎ করেই যেনো কান্নার রোল পড়ে। মাটিতে পড়ে রোদন করছিলেন সোহেলের মা হালিমা খাতুন। এ প্রতিনিধিকে দেখেই উঠে আসেন তিনি। বলছিলেন, ‘ বাবা, তোমরা কি আমার সোহেলেকে নিয়া আইছো? কই আমার কলিজার টুকরা?’ তিনি জানান, গত ২৩ মার্চ সবশেষ বাড়িতে এসেছিলেন সোহেল। সেদিন ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন, ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে শিঘ্র বাড়ি ফিরবেন। এরপর অগ্নিকান্ডে আহত হয়ে ঢাকা চিকিৎসাধীন থাকার সময় মায়ের দিকে মমতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন সোহেল। কথা বলতে পারেন নি। সুস্থ হয়ে ফিরে আসার প্রত্যয়ে বিমানবন্দরে ছেলের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল তার। এর পরই শুনলেন দু:স্বংবাদ। ছোট ভাই, বোন, দাদিসহ অসংখ্য আত্মীয় কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন।
নুন আনতে পানথা ফুরায় অবস্থা সোহেলের পরিবারের। একটি টিনের দোচালা ঘরে বাবা-মা চাচা-চাচিসহ সবাই থাকেন গাধাগাদি করে। বাবা দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইস রোগী। বাড়ির পাশের চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাশ করেন। কিন্তু টাকার অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা সোহেল রানার। তাই অটোরিসা চালিয়ে আর প্রাইভেট পড়িয়ে করিমগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন ২০১৪ সালে। পরের বছরেই যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসে। তার আয়েই চলতো পরিবারের ভরনপোষন ছাড়াও ছোট ভাইদের লেখাপড়া। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন স্বজনরা।
এলাকাবাসী বলছে, নিহত সোহেল রানা ছিল একজন বিনয়ি স্ভাবের ছেলে। বাড়ি এলে আশপাশের লোকজনের খোজÑখবর নিতেন। তিনি ছিলেন সহজ-সরল ও পরোপকারী। ৪ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সোহেল রানা ছিলেন প্রথম। এর পরই ছোট ভাই রুবেল ডিগ্রী পড়ছেন। তার ছোটজন উজ্জল করিমগঞ্জ কলেজে বিবিএস (অনার্স) পড়ছেন। আর সবার ছোট দিলোয়ার হোসেন স্থানীয় চৗগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। একমাত্র বোন সেলিনা আক্তারের বিয়ে হয়েছে।
চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিুর রহমান জানান, ‘ছেলেটি খুবই অমায়িক ছিল। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় আমরা তাকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করেছি। চাকুরি পাওয়ার পর বাড়ি এলেই স্কুলের খোজখবর নিত। তিনি জানান, ‘ছেলেটি সংসারের জন্য সব- সময় পরিশ্রম করতো। কলেজে পড়ার সময় লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে অটো চালিয়ে পরিবারের জন্য বাড়তি কিছুটা উপার্জন করতো।
গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ার নামে একটি ভবনে অগ্নিকান্ডের সময় সেখানে আটকে পড়াদের উদ্ধার করার সময় গুরুতর আহত হন ফায়ারম্যান সোহেলে রানা। তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে গত ৫ এপ্রিল উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার মধ্যরাতে তার মৃত্যু হয়।