নিজস্ব সংবাদদাতা : মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটা। কিশোরগঞ্জের সরকারি গুরুদয়াল কলেজের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিন মিয়া ভৈরব স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড যাচ্ছিলেন। বাহন রিকশা। স্টেশন থেকে প্রায় এক শ গজ দূরে পৌর কবরস্থান। শাহিনের রিকশা কবরস্থান এলাকা অতিক্রম করার সময় কয়েকজন ছিনতাইকারী ছোরা হাতে রিকশার গতি থামান। ঘিরে ধরেই শুরু হয়ে যায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত। সড়কে লুটিয়ে পড়েন শাহিন। সবকিছু কেড়ে নেওয়ার আগে আবার করা হয় ছুরিকাঘাত। অচেতন অবস্থায় শাহিন সড়কের পাশে পড়ে ছিলেন ১৫ মিনিট। পথচারীরা তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
শাহিনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বাবুন্দিয়া গ্রামে। বাবার নাম দুলাল মিয়া। শাহিন হলেন ভৈরব স্টেশন সড়কে সর্বশেষ আক্রান্ত ব্যক্তি।
ছিনতাইয়ের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ভৈরব থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ফিরে আসে। আসেন রেলওয়ে পুলিশ সদস্যরাও। তাঁরাও ঘটনাস্থলে এসে বেশিক্ষণ দাঁড়াননি। ফিরে যান গন্তব্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাস্থল ভৈরব থানার অধীন নয়—এমন ধারণা থেকে ফিরে যায় ওই থানা-পুলিশ। আবার ঘটনাস্থল পড়েছে ভৈরব থানা এলাকায়, সুতরাং এর দায়দায়িত্ব ভৈরব থানার—এমন যুক্তিতে সরে যায় রেলওয়ে পুলিশও। এতে ঘটনার এক দিন পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে দুই থানার কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়নি। ছিনতাইকারীরাও রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মো. শাহিন ওসি হিসেবে ভৈরব থানায় নতুন। এসেই তাঁর ঘোষণা ছিল চুরি, ছিনতাই ও মাদক নির্মূলসহ অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা হবে। এ জন্য বেশ কিছু উদ্যোগও সক্রিয় রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে তাঁর পুলিশের ফিরে আসার ব্যাপারে ওসির ভাষ্য, ‘ঘটনাস্থলটি স্পষ্টতই রেলওয়ে থানার অধীনে পড়েছে। সেখানে তো আর আমরা কিছু করতে পারি না।’
ওসি জানালেন, ছিনতাইকারীরা রেললাইনে হাঁটাহাঁটি করে। সুযোগ বুঝে পথচারীদের ওপর চড়াও হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ হলো, রেলওয়ে পুলিশ যদি রেললাইন এলাকায় টহল দেয়, তাহলে চিত্রের পরিবর্তন আসতে পারে।
তওসির এমন দাবি মানতে নারাজ ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস। তিনিও ভৈরবে নতুন। কর্ম এলাকার আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করবেন, এমন ঘোষণা ছিল তাঁর পক্ষ থেকেও। ফেরদৌস আহমেদ বলেন, রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী রেলপথের দুই পাশের ১০ গজ পর্যন্ত এলাকা রেলওয়ে থানার অধীন। ঘটনা ঘটেছে স্টেশন সড়কে। রেলপথ থেকে সড়কের দূরত্ব ৫০ গজের বেশি হবে। সুতরাং দায়দায়িত্ব ভৈরব থানারই।
ভৈরব থানার ওসির পরামর্শের ব্যাপারে রেলওয়ে থানার ওসির বক্তব্য হলো, ‘আমাদের পুলিশ ঠিকই রেলপথে টহলে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে গেলেই ছিনতাইকারীরা ঝোপ বুঝে কোপ মারছে।’
মো. সুরুজ্জামান ভৈরব রেলওয়ে থানার সবচেয়ে পুরোনো উপপরিদর্শক। থানার কর্ম এলাকা সম্পর্কে তাঁর ধারণা বেশি। রেলওয়ে থানার ওসির যুক্তির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে সুরুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনার পর ঘটনাস্থলে আমি গিয়েছিলাম। পৌর কবরস্থান আর রেলওয়ে সড়ক যে আমাদের নয়, এটি সবারই জানা।’
পরে অবশ্যই উভয় থানার ওসি এক জায়গায় একমত হন, প্রশাসনিক এলাকা যে থানারই হোক না কেন, সমস্যার প্রতিকার হওয়া জরুরি। তাই সীমানা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দূর করতে সভা করে উপায় বের করবেন বলে জানান উভয় থানার ওসি।
সীমানা নির্ধারণ নিয়ে দুই থানার রশি টানাটানিতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পথচারী ও স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, দুই বছর ধরে ভৈরবে চুরি–ছিনতাই বেড়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ছিনতাই ভীতি কাজ করে। দুই মাসের ব্যবধানে পৌর শহরের স্টেশন সড়ক, নাটাল মোড় ও বঙ্গবন্ধু সরণি সড়কে অন্তত ২৫ জন পথচারী ছিনতাইকারীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে সর্বস্ব খোয়ানোর পাশাপাশি ছুরিকাঘাতে জখম হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু স্টেশনে সড়কে অন্তত ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই ভৈরবের বাইরের পথচারী। ছিনতাইমুক্ত ভৈরব দাবিতে ইতিমধ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এরপর ছিনতাইয়ের মাত্রা কমে এলেও নির্মূল হয়নি। বর্তমানে স্টেশন সড়কটি পুরোপুরি অরক্ষিত রয়েছে। এ সড়কে প্রায়ই কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় স্টেশন সড়ক নিরাপদ রাখতে উপজেলা প্রশাসন ও পৌর প্রশাসন যৌথ উদ্যোগে রেললাইনের পাশ থেকে ঝোপ পরিষ্কার করে। অভিযোগ, ছিনতাইকারীরা ঝোপে লুকিয়ে থেকে অপকর্ম করে আসছিল। ঝোপ পরিষ্কার করার পর স্টেশন সড়কটি এখনো নিরাপদ না হওয়ার কারণ ঘটনাস্থলের দায় নিয়ে দুই থানার ঠেলাঠেলি।
বোরহান উদ্দিন রেলস্টেশনের ভ্রাম্যমাণ হকার। এ বিষয়ে তাঁর সহজ–সরল মন্তব্য হলো, ‘হিলে (শিল) পাডায় (পাটা) ঘষাঘষি, মরিচের কাম শেষ।’