টিটু দাস: কারো কাঁধে ঝুলছে ঢাক। কেউ হাতে বয়ে বেড়াচ্ছেন সানাই, নানা জাতের বাঁশি, করতাল ও মঞ্জুরীসহ নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী দেখাতে এসেছেন সবাই। কিন্তু আদতে তা নয়। এদের সবাই এসেছেন শ্রম বেঁচতে। রীতিমতো হাট বসিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তারা। রীতি অনুযায়ী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজা উপলক্ষে পূজার আগেরদিন ও শুরুর দিন বসে এ হাট।
গত প্রায় ৫০০ বছর ধরে এভাবেই ঢাকের হাট বসছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদরের পুরান বাজারে। এ দুইদিন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পূজা মন্ডপ, এলাকায় বা এ বাড়ি ও বাড়ি বাদ্যযন্ত্র বাজান তারা।
সারাবছর তাদের তেমন কদর না থাকলেও ঢাকি ও বংশী বাদকদের চাহিদা এ সময়ে থাকে তুঙ্গে। রোববার (১৪ অক্টোবর) সরেজমিনে ৫শ’ বছরের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট ঘুরে জানা যায় এসব তথ্য।
হাট ঘুরে দেখা যায়, ঢাকের বাদক বা ঢাকিওয়ালা জোগাড় করতে পূজা আয়োজকদের ভিড় জমেছে ঢাকের হাটে। হাটে ঢাকিরা এসেছেন মুন্সীগঞ্জ, ঢাকার নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর ও নরসিংদী থেকে। সঙ্গে এনেছেন ঢাক, কাসি, সানাই, নানা জাতের বাঁশি, করতাল, মঞ্জুরীসহ নানা বাদ্যযন্ত্র।
হাটে আসছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পূজা আয়োজকরা। তারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে হাট থেকে বাদক নিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকের হাটের আয়োজকদের দাবি, বাংলাদেশে আরে কোথাও এ ধরণের হাট বসে না। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে হাটটি এখন গর্ব ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে উঠেছে।
এদিকে, হাটে আসা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ঢাকি ও বংশী বাদকেরা বাজনা বাজিয়ে, নেচে ও নানা ঢংয়ে অঙ্গ-ভঙ্গি প্রদর্শন করছেন। ফলে হাট এলাকা হয়ে উঠেছে এক টুকরো উৎসবস্থল। মুখরিত হয়ে উঠেছে আশপাশের এলাকা।
হাটের ক্রেতা ও ঢাকিরা জানান, ক্রেতারা কাউকে পছন্দ করার পর চলে দর কষাকষি। সাধারণত দলভিত্তিক চুক্তি হয়ে থাকে। প্রকারভেদে ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় এক একটি দল। দুর্গা পূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত তারা মন্ডপে অবস্থান করে বাদ্য-বাজনা করেন।
নরসিংদীর চালাকচর থেকে আসা ক্রেতা সুমন দেবনাথ বলেন, আমি শুধু ঢাক নিতে এসেছি। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকির দাম কম মনে হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও থেকে আসা মনোরঞ্জন দে বলেন, কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাটে আমি প্রতিবছর আসি এবং ঢাকিদের নিয়ে যাই। এ বছরও দুই ঢাকিকে নিয়ে যাচ্ছি।
তবে স্থানীয়রা জানান, ঢাকের হাটের ঐতিহ্যের বিপরীতে রয়েছে দুঃখও। প্রতি বছর শত শত ঢাকি পুরান বাজারে এসে ভিড় করলেও তাদের নেই কোনো থাকার ব্যবস্থা। তাই বাদকদের স্থানীয় আখড়াগুলোতে অবস্থান নিতে হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গা পূজার আয়োজন করতেন। রাজ্যের চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজমহল। একসময় রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকির সন্ধান করতে বিক্রমপুর পরগণার (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সেসময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতীরের কটিয়াদীর যাত্রাঘাট নামক স্থানে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু হয়। পরে তা স্থানান্তরিত হয়ে পুরান বাজারে বসছে।