নিজস্ব সংবাদদাতা : গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বল্প খরচে সাধারণ মানুষকে ইউরোপ পাঠানোর প্রলোভন দেখানো হতো। ফাঁদে পা দিলেই তাঁর পাসপোর্ট, ভিসা, বিমান টিকিটের কাজ শুরু করত সিন্ডিকেট চক্র। এরপর নির্বাচিত ব্যক্তিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে (কলকাতায়) পাঠানো হয়। ভারত থেকে তাঁরা পাড়ি জমান লিবিয়ায়। সর্বশেষ ধাপে গিয়ে লিবিয়া থেকে পাঠানো হয় ইউরোপে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধপথে ইউরোপ যাত্রার এই প্যাকেজে খরচ হয় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা।
লিবিয়ায় অপহরণকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তিনজনকে আটক করার পর এমন তথ্য জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আজ বুধবার ভোরে ভৈরব পৌর শহরের তাতারকান্দি, লক্ষ্মীপুর ও শম্ভুপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের আটক করে র্যাব। আটক ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের হেলাল মিয়া (৪৫), পৌর শহরের তাতারকান্দি এলাকার খবির উদ্দিন (৪২) ও লক্ষ্মীপুর এলাকার শহিদ মিয়া (৬১)।
বুধবার (০৩ জুন) দুপুরে র্যাবের পক্ষ থেকে ভৈরব ক্যাম্পে আটক ব্যক্তিদের হাজির করে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে র্যাব-১৪ অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ এফতেখার উদ্দিন, ভৈরব ক্যাম্পের অধিনায়ক রফিউদ্দীন মোহাম্মদ যোবায়ের ও সিনিয়র এডি চন্দন কুমার দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আটক ব্যক্তিরা লিবিয়ার ঘটনায় হতাহতের তালিকায় তাঁদের পাঠানো লোক থাকার কথা স্বীকার করেন।
লিবিয়ায় নিহত ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে ভৈরবের নিহত মোহাম্মদ আলী, মাহবুব রহমান ও আহত জানু মিয়া পরিস্থিতির শিকার হন পাচারকারী মো. হেলাল মিয়ার মাধ্যমে। নিহত সাকিব মিয়া, সাদ্দাম হোসেন আকাশ, মো. শাকিল ও আহত সোহাগ মিয়াকে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন পাচারকারী তানজিল ইসলাম। তিনি বর্তমানে লিবিয়ায় আছেন। নিহত রাজন চন্দ্র দাস লিবিয়ায় পাড়ি জমান পাচারকারী জাফর মিয়া ও তাঁর স্ত্রী রুপা আক্তারের মাধ্যমে। তাঁদের আটক করা যায়নি। পাচারকারী খবির উদ্দিন ও শহিদ মিয়া একই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে কীভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে ইউরোপে পাঠানো হয়, তা তুলে ধরেন র্যাব কর্মকর্তারা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রথম ধাপে দালালেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের লোক খোঁজ করেন। এরপর অল্প খরচে বিদেশ পাঠানোর প্রলোভন দেখানোর প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেন। বিনিময়ে বিপুল অর্থ আয়ের স্বপ্ন দেখানো হয়। তখন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই প্রস্তাবে সাড়া দেন। পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট কেনা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অর্থ পরিশোধ হয় এককালীন কিংবা ধাপে ধাপে। ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছার প্যাকেজ খরচ ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। লিবিয়া যাওয়ার আগে তিন থেকে চার লাখ টাকা দিতে হয়। লিবিয়া যাওয়ার পর বাকি টাকা পরিবার ও স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হয়।
চক্রটি বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে কয়েকটি পথ ব্যবহার করে থাকে। পরিস্থিতি বুঝে পথ বদল হয়। সম্প্রতি লিবিয়াতে পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই-মিসর-বেনগাজী-ত্রিপোলি (লিবিয়া) পথটি ব্যবহার করা হচ্ছে। দুবাই পাঠানোর পর বিদেশি এজেন্টদের অধীনে এক সপ্তাহের মতো সময় রাখা হয় বেনগাজীতে পাঠানোর জন্য। বেনগাজী থেকে এজেন্টরা কথিত ‘মরাকাপা’ নামক একটি ডকুমেন্ট দুবাই পাঠিয়ে থাকে, যা দুবাইয়ে অবস্থানরত বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের কাছে দেওয়া হয়। ডকুমেন্টসহ বিদেশি এজেন্ট তাঁদের মিসর ট্রানজিট নিয়ে বেনগাজী পাঠায়। বেনগাজীতে বাংলাদেশি এজেন্ট তাঁদের বেনগাজী থেকে ত্রিপোলিতে স্থানান্তর করে।
ত্রিপোলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি এজেন্ট বিদেশে পাঠানোদের গ্রহণ করে থাকে। পরে তাঁদের ত্রিপোলিতে বেশ কয়েক দিন অবস্থান করানো হয়। এ সময় দেশীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভিকটিমদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। তারপর ত্রিপোলি বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেটের কাছে অর্থের বিনিময়ে ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে তাঁদের হস্তান্তর করা হয়। ইউরোপ পাঠানোর সিন্ডিকেট তাঁদের একটি নিদিষ্ট স্থানে রেখে থাকে। তারপর সমুদ্রপথ অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা এবং দিকনির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোররাতে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া থেকে তিউনেসিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাওয়ার সময় ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার শিকার হন এবং জীবনাবসানের ঘটনা ঘটে থাকে।
র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের অধিনায়ন রফিউদ্দীন মোহাম্মদ যোবায়ের বলেন, ভৈরবে একাধিক মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আটক ব্যক্তিদের মাধ্যমে জানা গেল। এখন চক্রের বাকি সদস্যদের আটকের চেষ্টা চলছে।