নিজস্ব সংবাদদাতা : ‘১৬ মে, শনিবার। ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটা বাজতে তখনও ১১ মিনিট বাকি। অন্ধকারে দমকা বাতাস, মেঘনা নদীর দক্ষিণ তীরে শ্মশানঘাটের চিতার শেষ আগুন তখন নিভে গেছে। পাশে কোনও আত্মীয় বা প্রতিবেশী নেই। জনমানবহীন নীরব রাতের আঁধারে দূরে আলোর রেখা দেখা গেলেও শূন্যতা তখন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলরাম দাসের শেষ চিহ্নটুকু তখন শুধুই ছাইভস্ম।’
মঙ্গলবার (২৬ মে) রাতে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে এই বর্ণনা শুনে প্রথমে গল্প মনে হলেও করোনার এই সংকটে এটিই এখন বাস্তবতা। নির্মম সেই বাস্তবতার কাহিনি তুলে ধরে কথাগুলো টানা শুনিয়ে যাচ্ছিলেন করোনা দুর্যোগকালীন ‘কুইক রেসপন্স টিম’-এর আহ্বায়ক নরসিংদী সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহ আলম মিয়া। রাত পৌনে ১১টায় শাহ আলম মিয়া যখন ফোনে এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন তিনি ছুটছেন নরসিংদী সদরের কান্দাপাড়া এলাকায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া দীলিপ কুমার নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তির সৎকারের কাজে।
সৎকারের আগে শ্মশানে বলরাম দাসের মরদেহকরোনায় মানুষের মৃত্যুর নির্মমতা তুলে ধরে তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট শাহ আলম জানান, পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব বলরাম দাস মারা গেছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে। তার করোনা হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করা না গেলেও মৃত্যুর পর ধারে-কাছেও আসেননি কোনও আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী। এমনকি নিকটাত্মীয়রাও ভয়ে পালিয়ে গেছেন। নরসিংদী সদর উপজেলার বৌয়াকুড় এলাকার এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মারা যান গত ১৬ মে রাতে। ‘কুইক রেসপন্স টিম’-এর কাছে খবর আসে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন বলরাম দাস। তার সৎকারের কোনও লোক নেই, এমনকি নিকটাত্মীয়রাও তার সৎকারের ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এই পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেট শাহ আলম মিয়া জেলা পুলিশের দুই সদস্য, দুই জন স্থানীয় সাংবাদিক, একজন প্রতিবেশীর উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নরসিংদীর মেঘনা নদীর দক্ষিণ তীরে শ্মশানঘাটে বলরামের মরদেহ সৎকারের প্রস্তুতি নেন। শ্মশানঘাটের নির্ধারিত ডোম চিতা সাজিয়ে দিলে বলরাম দাসের এক আত্মীয়কে দিয়ে মুখাগ্নি করে ১৬ মে রাত সাড়ে ১১টায় তার মরদেহের সৎকার শুরু হয়। মুখাগ্নির পর চুপি চুপি বিদায় নেন বলরামের ওই নিকট আত্মীয়। দাহ শেষ হয় রাত ২টা ৪৯ মিনিটে। এরপর ঘরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও বৃদ্ধ মায়ের কাছে শেষ রাতে ঘরে ফেরেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহ আলম মিয়া।
শুধু বলরামই নন, আরও অনেকে মারা গেছেন তার মতো করোনা আক্রান্ত হয়ে। মৃতদের সৎকারে কেউ এগিয়ে না এলেও ম্যাজিস্ট্রেট শাহ আলম মিয়া খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়ে সৎকারের কাজে।
সৎকারের আগে শ্মশানে সুধীর সাহার মরদেহজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদীতে মঙ্গলবার (২৬ মে) পর্যন্ত মারা গেছেন ১০ জন। এদের মধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান বলরাম দাস। আর মারা যাওয়া নিখিল দাস, আলহাজ শরিফ হোসেন মুক্তার, শংকর সাহা ও সাইমুম আক্তার করোনা পজিটিভ ছিলেন। এছাড়া, মৃত সুধীর সাহা, অনীল কুমার সাহা, দীলিপ কুমার ও শাহেরা বেগমের করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে তাদের রিপোর্ট এখনও আসেনি বলে জানায় রেসপন্স টিম।
বলরামের মৃত্যুর ঘটনা ছাড়াও ফেসবুকের টাইমলাইনে বারবার ফিরে আসে নরসিংদীর কয়েকটি ঘটনা। টাইমলাইনে ঘুরে-ফিরে আসা পোস্টগুলোর একটিতে দেখা গেছে, করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে শুনলেই ওই এলাকার কিছু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হওয়াকে গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য করে। নরসিংদীতে গত ২৩ মে করোনা আক্রান্ত একটি পরিবারের বাসার গেটে ময়লা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই তথ্য ‘কুইক রেসপন্স টিম’-এর কাছে পৌঁছালে সেখানে ছুটে যান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহ আলম মিয়া। মানবতা বিবর্জিত এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধে ওই এলাকায় মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক করার ব্যবস্থা নেন তিনি। এতে সাধারণ মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা পান তিনি।
নিজের ফেসবুক ওয়ালে শাহ আলম মিয়া লিখেছেন—‘করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি কোনও অপরাধী নন, তিনি একটি দুর্যোগ পরিস্থিতির শিকার মাত্র। তার প্রতি ভালোবাসা, মানবতা ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করুন।’
নরসিংদী জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ‘কুইক রেসপন্স টিম’ শুধু যে সৎকারের কাজই করে তা নয়। সকাল থেকে ত্রাণ বিতরণ, সামাজিক সংগঠনগুলোকে মানুষের সহযোগিতার জন্য কাজে লাগানো, অসহায় মানুষের বাসায় খাবার ও ইফতার পৌঁছে দেওয়াসহ ভোর থেকে পরবর্তী মধ্যরাত পর্যন্ত অবিরাম চলে তাদের কর্মতৎপরতা। এছাড়া, হোম আইসোলেশন ও হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সহযোগিতার জন্য প্রতিবেশীদের অনুরোধ করার কাজও চলে রুটিন মাফিক।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহ আলম মিয়াশাহ আলম মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোজার সময় এবং ঈদের দিন অসহায় মানুষের কাছে ত্রাণ ও খাবার পৌঁছানো থেকে শুরু করে রোগীদের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সসহ দ্রুত অন্যান্য ব্যবস্থা করা, হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের খোঁজ-খবর নেওয়া, চিকিৎসকসহ চিকিৎসাকর্মীদের সহায়তার কাজ করছি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়াও করোনায় মারা যাওয়া মানুষের বাসায় তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ত্রাণ পৌঁছনোসহ দুর্যোগকালীন সব কাজই করতে হচ্ছে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে।’
নরসিংদী জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইনডিপেনডেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধা বলেন, ‘ভয়াবহ এই করোনা দুর্যোগের সময় এ জেলায় যে ক‘জন প্রাণের মায়া না করে, মানুষের জন্য কাজ করছেন, এসিল্যান্ড শাহ আলম তাদের অন্যতম। ঘরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে রেখে দিনরাত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। করোনা দুর্যোগে তিনি মানুষের জন্য আমাকে দিয়েও কাজ করিয়েছেন।’
এদিকে, নরসিংদীর জেলা প্রশাসনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেখা গেছে, শাহ আলমসহ অন্যান্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট—যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের প্রশংসা করেছেন জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন। কুইক রেসপন্স টিমের সব কাজের বর্ণনা তিনি নিজেই তুলে ধরেছেন তার ফেসবুক পেজে।