সাইফুল হক মোল্লা দুলু : উপমহাদেশের রাজনীতিতে তৃণমুল থেকে উঠে আসা স্বচ্ছ ও নির্মোহ রাজনীতির প্রতীক তিনি। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি দলের কেন্দ্রিয় কমিটির কোন আসন অলংঙ্কৃত করেননি। তবে, কখনোই দলের নীতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আর্দশ থেকে সরে দাঁড়াননি। কখনও পরাভূত হননি ক্ষমতার লোভ কিংবা স্পৃহার কাছে। প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিশোধপরায়নতায় কখনও নিজেকে অথবা নিজের দলকে অকারণে লিপ্ত করেননি রাজনৈতিক সংঘাতে।
তাঁর এই আর্দশিক, নীতি, সততা ও স্বচ্ছতা বিনয়ী মানুষটিকে নিজদলসহ সকল দলের কাছেও করে তুলেছে গ্রহণযোগ্য। নিজের যোগ্যতা বলেই তিনি হয়ে উঠেছেন রাজনীতির বরপুত্র এবং নিজ জেলার রাজনীতির সেরা ব্যক্তিত্ব ও আন-প্যারালাল লিডার। এই রাজনীতিবিদ আর কেউ নন, বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন- তিনিই মো. আবদুল হামিদ।
আজ ২৪ এপ্রিল মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার দ্বিতীয় বার্ষিকী পূর্ণ হলো। এই দিনটি কিশোরগঞ্জবাসীর জন্য নয় সারা দেশের জনগণের জন্য শুধু গৌরবেরই নয়, অন্যরকম আনন্দেরও দিন।
স্পিকারের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি তার বিচক্ষণতা দিয়ে সকল দলের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এরপর প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি আবারও তার কর্মকাণ্ড দিয়ে সকল দল ও মতের মানুষের কাছে একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের ইমেজ গড়ে তোলেন।
তাঁর এই যোগ্যতা ও বিচক্ষণতাই তাঁকে ক্ষমতাসীন দলের কাছে এবং দলের নেত্রীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। যার পুরস্কার হিসেবে কিশোরগঞ্জের ভাটির শার্দুলখ্যাত অনুসরণীয় ও বিরল রাজনীতিক মো. আবদুল হামিদ টানা দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রের প্রধান প্রতীক রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ভারতীয় উপ-মহাদেশে একই ব্যক্তির টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
তৃণমূল পর্যায়ের একজন সাধারণ ছাত্রনেতা থেকে কলেজের ভিপি হওয়া, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মনোনয়নে জাতীয় পরিষদে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন নির্ভীক সংগঠক হিসেবে ভারতের বালাট ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করা, ’৭৫-এর পর দলের দুর্দিনে সকল প্রলোভনকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কারা নির্যাতন ভোগ করা, কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সামরিক শাসনের মধ্যেও তৃণমূলে নিজের দলকে সুসংগঠিত করা ইত্যাদি নানা ত্যাগ ও সাহসের সাথে দুর্যোগ মোকাবেলা করে মো. আবদুল হামিদ দলে একজন পরীক্ষিত ও নিবেদিত রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। এসব কারণেই তিনি দল থেকে সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা মনে করেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বর্ষ পূর্তিতে চলমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ‘কিশোরগঞ্জ নিউজ’ এর সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রথমে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘কোভিড-১৯ বিশ্ব পরিস্থিতির এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশেও আজ ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় আমি দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকার তার জায়গা থেকে সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও মানুষের অসচেতনতা আমাদের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। যদি জনগণ সহায়তার হাত বাড়ায়।
দেশের এই ক্রান্তিকালে সব রাজনীতি মতভেদ ভুলে গিয়ে সকলকে এক যুগে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দলীয় সংকীর্ণতার কোনো সুযোগ নেই। আর দলীয় পরিচয়ে যারা বিপন্ন মানুষের ত্রাণ লুটপাট করছে তাদের ব্যাপারেও সরকারকে আরও কঠোরও কঠিন পথ অবলম্বন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে জনগণের সচেতনেতা। জনগণ যদি সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করেন, তাহলে আমরা এই সংকট সহজেই কাটিয়ে উঠতে পাবরো।
আমি আমার দ্বিতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বর্ষ পূর্তিতে জনগনের কাছে এই আশা ও প্রত্যাশা করি।’
করোনাকালে তিনি সকল দলের নেতা-কর্মীদের বিনয়ী ও দেশসেবায় ব্রত হয়ে সুন্দরের চর্চার আহবান জানান।
বাংলাদেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আজ ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে শপথগ্রহণের আজ তাঁর দ্বিতীয় বছর। হাওর উপজেলা মিঠামইনের কামালপুর গ্রামে মো. আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজি মো. তায়েব উদ্দিন ও মা মোছা. তমিজা খাতুন। রাষ্ট্রপতির শৈশব কেটেছে নিজ গ্রাম কামালপুরে। এখানেই জড়িয়ে আছে তার স্মৃতিকাতর শৈশব-কৈশোর।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শৈশবে কামালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে ভৈরব কেবি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষে নিকলী গোরাচাঁদ (জেসি) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন।
এরপর কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাস করেন। পরে ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি শেষ করে রাজনীতির পাশাপাশি কিশোরগঞ্জ জজকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন তিনি। তিনি জেলা বারের পাঁচ পাঁচ বার সভাপতি নির্বাচিত হন।
আবদুল হামিদ অষ্টগ্রাম-ইটনা-মিঠামইন সংসদীয় আসন থেকে সাত সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ১৩ জুলাই তিনি সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। পরে ২০০১ সালের ১১ জুলাই থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যু হলে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ভাটির শার্দুল মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ২১ এপ্রিল মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। অন্যকোন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল না করায় যাচাই-বাছাইয়ের পর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ ২২ এপ্রিল মো. আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ২৪ এপ্রিল ২০১৩ ভারপ্রাপ্ত স্পিকার শওকত আলীর কাছ থেকে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভায় মো. আবদুর হামিদকে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর তৎকালীন জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ আবদুল হামিদের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। আবদুল হামিদ তাতে স্বাক্ষর করেন। পরে তা নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশন ৭ ফেব্রুয়ারি আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
২৪ এপ্রিল স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মো. আবদুল হামিদকে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে তাঁর দুই মেয়াদে সাত বছর পূর্ণ হয়েছে আজ ২৪ এপ্রিল।