রাজীবুল হাসান , ভৈরব প্রতিনিধি : দীর্ঘদিন যাবত মাদক ব্যবসার ট্রানজিট রোড ভৈরব। তিন জেলা কিশোরগঞ্জ, নরসিংদি ও ব্রাহ্মণড়ীয়ার জেলার মধ্যস্থল শহর বানিজ্য বন্দরনগর খ্যাত ভৈরব উপজেলা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত শহর হিসেবে এখানে প্রতিদিন বানের মত আসছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। এসব মাদকের মধ্য রয়েছে ইয়াবা ট্যাবলেট, গাঁজা, ফেনসিডিল, হিরোইন, মদ, বিয়ার ইত্যাদি রয়েছে। ভৈরবে আমদানি হওয়া বেশীর ভাগ মাদকদ্রব্য দেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিদিন পাচার হচ্ছে। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ভৈরবে গড়ে উঠেছে কয়েকটি সেন্ডিকেট। এসব সেন্ডিকেটগুলি পুলিশসহ একটি প্রভাবশালী মহল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর মাদক ব্যবসা চলমান রাখতে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকার বাটবাটোয়ারা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আবার মাদক সেবনকারীর সংখ্যাও ভৈরবে কম নয়। সেবনকারীর মধ্য ধনীর সন্তানরাও রয়েছে। অনেক মা বাবা সন্তানকে মাদক থেকে ফেরাতে না পেরে নিজেই পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে। মাদক সেবন ও ব্যবসা করে সমাজকে নষ্ট পথে নিয়ে গেলেও কেউ ফেরাতে পারছেনা এসবের নিয়ন্ত্রণ।
গত ১৭ মে বৃহস্পতিবার রাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা টিম অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার ইয়াবাসহ মাদকসম্রাট ফরিদকে তার স্ত্রীসহ আটক করে।পরে গোয়েন্দা টিম বাদী হয়ে ভৈরব থানায় ১টি মামলা দায়ের করে কোর্টে প্রেরণ করা হয়। তার বিরুদ্ধে থানায় ১৬টি মামলা রয়েছে বলে জানান ভৈরব থানা পুলিশ।
গত ১০মে মঙ্গলবার সকালে ভৈরব র্যাব – ১৪ সদস্যরা ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার বাঞ্চরামপুর উপজেলার কড়ইকান্দি ফেরীঘাট থেকে ১১ হাজার ৬ শ ২০ পিচ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। এসময় র্যাব সদস্যরা মাদক বহনকারী একটি পিকআপ ভ্যান ( নাম্বার – ঢাকা মোট্রো – ন – ১৭২৫ – ৬৫) উদ্ধার করে। আটককৃত মাদক ব্যবসায়ীরা হল নুরুজ্জামান ( ২৯) ও আক্তার হোসেন ( ২৩) । এছাড়াও গত এক সপ্তাহে র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্হান থেকে ৬ হাজার পিচ ইয়াবা, ২ হাজার লিটার মদসহ ১৯ মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে থানায় সোপর্দ করে মামলা দায়ের করেছে।
ভৈরব র্যাব – ১৪ ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে র্যাব-১৪ এর সদস্যরা ইয়াবা ট্যাবলেট ১ লাখ ১০ হাজার, ভারতীয় ফেনসেডিল ৩ হাজার ১ শ ৯৩ বোতল, স্কাপ ১ শ ৯৩ বোতল, ৩৪ গ্রাম হেরোইনসহ বিপুল পরিমান মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ ১ শ ৬ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা করেছে র্যাব সদস্যরা। এদিকে গত এক বছরে ভৈরব থানায় প্রায় ২ শ মাদক মামলাসহ প্রায় ৩ শ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। থানা পুলিশ উদ্ধার করেছে কয়েকশ কেজি গাজা, হাজার হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট ও ফেসেডিল, মদ, বিয়ার। এক বছরে মাদক সেবনকারীদের মধ্য প্রায় ৫০ জনকে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমান আদালতে জেল জরিমানাও করেছে ভৈরব থানা পুলিশ। তবে মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেও তারা কিছুদিন জেল খাটার পর আদালত থেকে জামিন পেয়ে আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পরে, এই অভিযোগ পুলিশের। অনেক মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীর বিরুদ্ধে ভৈরবসহ আশেপাশের থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এসব বিপুল পরিমান মাদক উদ্ধার করলেও এর ১০ গুন পরিমান মাদক ভৈরব রোডে দেশের বড় বড় শহরে পাচার হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। আমদানীকৃত মাদকের সামান্য অংশ ভৈরবে বেচাকেনা হলেও ৯০ % মাদক ট্রানজিট রোড হিসেবে এখান থেকে পাচার হয়েছে। সড়ক, নৌ ও রেলপথে প্রতিদিন মাদক আসছে ভৈরবে। রেলওয়ে থানা পুলিশও প্রায়ই ট্রেন থেকে মাদকদ্রব্যসহ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করছে। ভৈরবে রয়েছে একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অফিস। এই অফিসের পরিদর্শক কামনাশীষ নিজেই গত নভেম্বর মাসে ৬৮ কেজি গাঁজা ও ২৪ বোতল ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। সিজারলীষ্টবিহীন মাদক রাখার অভিযোগে এব্যাপারে ভৈরব থানায় একটি মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভৈরবে এখন রক্ষক হয়েছে ভক্ষক। ভৈরবে মাদক ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র এখন শ্রীনগর , কালিকাপ্রসাদ এলাকা, শহরের জগনাথপুর, গাছতলাঘাট, কালিপুর, পপঞ্চবটি , কমলপুর, ঘোড়াকান্দা, পলতাকান্দা, শম্ভুপুর এলাকা অন্যতম। এসব এলাকায় কমপক্ষে ৫০ টি স্পটে মাদক বেচাকেনার অভিযোগ রয়েছে। ভৈরবের হাজার হাজার কিশোর যুবক এখন নেশাগ্রস্থ হয়ে জীবন নষ্ট করছে। অভিযোগ রয়েছে এক শ্রেনীর অসৎ পুলিশ, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্র ছায়ায় লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ভৈরবে মাদক ব্যবসা ও সেবন চলছে অবাধে। এখানে বানের মত আসছে মাদক এবং যাচ্ছে মাদক। প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা ও লাখ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারর উৎসবে ভৈরব। পুলিশ বলছে আমরা মাদক ব্যবসা আগের তুলনায় অনেকটা কমিয়েছি কিন্ত একেবারে নির্মূল করতে পারেনি। রাজনীতিবিদরা বলছে মাদকের কারনে সমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কঠোর হতে হবে।
ভৈরব পৌর মেয়র এড.ফখরুল আলম আক্কাছ বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকায় ট্রানজিট শহর হিসেবে ভৈরবকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এখন স্থানীয়ভাবেও কিছু কিছু কিশোর, যুবক মাদক সেবনে ঝুঁকে পড়েছে। তিনি বলেন গত বছর আমি পৌর এলাকার প্রতিটি ওয়াডে মাদক প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু জনগণের সহযোগীতা না পাওয়াই কমিটিগুলি নিস্কৃয় হয়ে পড়েছে। আইন শৃংখলা বাহিনীকে আরও কঠোর হলে মাদক নির্মূল করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোখলেছুর রহমান জানান, পুলিশ প্রতিদিনই মাদকের অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধারসহ আসামী গ্রেফতার করছে। প্রতিমাসে ১৫/২০ টি মামলাও হচ্ছে ভৈরব থানায় এবং মাদক সেবন ও ব্যবসায়ীকে প্রতিনিয়ত গ্রেফতার করে কিশোরগঞ্জ আদালতে চালান দেয়া হচ্ছে। অপরাধীরা আদালত থেকে জামিন পেয়ে আবারও এপেশায় জড়িয়ে পড়ছে। ভৈরবে একটি মাদক নিয়ন্ত্রণ অফিস থাকলেও তারা সঠিকভাবে কাজ করেনা বলে তিনি অভিযোগ করেন। মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের চুক্তির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন আমি থানায় যোগদানের পর মাদক ব্যবসা ও সেবন অনেকাংশে কমিয়েছি। তবে মাদকের ব্যাপারে আমি কখনও আপোষ করি না,কখনো করব না বলে তিনি দাবী করেন।