হাওর বাংলা ডেস্ক : নাম তার মোকাররম সরদার। ছিলেন দিনমজুর। কয়েক বছর আগেও প্রতিদিন ৮০ টাকা মজুরিতে কাজ করতেন। হঠাৎ করেই তিনি শ্রমিকদের সর্দার বনে যান।
আর রাতারাতি পাল্টে যায় তার জীবনচিত্র। হাঁকাতে শুরু করেন অর্ধকোটি টাকা মূল্যের গাড়ি। গ্রামের বাড়ি যেতে ব্যবহার করেন হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার কিংবা গাড়ি থেকে নামার পরই তার পিছু নেয় শত শত মানুষ।
রীতিমতো উৎসব ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। সহজসরল মানুষ উপস্থিত হন কিছু টাকার আশায়। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি বিশাল বড়লোক। মোকাররম কত টাকার মালিক, তা নিজেও জানেন না। কোটি টাকা লগ্নি করে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন তিনি।
মোকাররমের এ পরিবর্তনে অনেকেই অবাক। মোকাররমের এ উত্থানের পেছনে ফতুল্লার গডফাদারখ্যাত শ্রমিক লীগ নেতা কাউসার আহমেদ পলাশের সরাসরি আশীর্বাদ রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কিশোরগঞ্জের নিকলী থানা বিএনপির কার্যকরী সদস্য তিনি।
মোকাররম নিকলী থানার উত্তর দামপাড়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। একসময় নুরুল ইসলাম তার ছেলে মোকাররমকে নিয়ে ফতুল্লার আলীগঞ্জ ও পাগলা এলাকায় ৮০ টাকা রোজে দিনমজুরের কাজ করতেন।
একপর্যায়ে মোকাররম বুড়িগঙ্গার তীরে থাকা জাহাজ থেকে কয়লা, গম, চাল, ডাল, সারের বস্তা মাথায় উঠিয়ে ট্রাকে তোলার কাজে যোগ দেন। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কাজ করে মজুরি পেতেন মাত্র ৮০ টাকা। এ টাকায় চলত তাদের পরিবার।
৮-১০ জন সাধারণ লোড-আনলোড শ্রমিকের মতোই দিনযাপন করতেন মোকাররম। সেই শ্রমিক মোকাররম এখন পাগলা ও আলীগঞ্জ এলাকার লোড-আনলোড শ্রমিকদের সর্দার। আর সর্দারির আড়ালেই তিনি কোটিপতি বনে গেছেন।
স্থানীয়দের একটি সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় কয়েকটি কোম্পানি জাহাজের মালামাল রেখে চলে যায়। সেখানকার মালামাল লুট করেই কোটি টাকার মালিক বনে যান মোকাররম। তাছাড়া শ্রমিকদের কাছ থেকে কমিশন নিয়েও আয় হয় লাখ লাখ টাকা। এভাবে বদলে গেছে তার জীবনচিত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘ইভটিজিং’ সিনেমা তৈরিতে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন মোকাররম। ওই ছবিটি ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায়।
এ বিষয়ে মোকাররম জানান, একজনের মাধ্যমে পরিচয়ে কাজী হায়াৎ তার পরিচালিত সিনেমায় তাকে প্রযোজক হিসেবে নাম দিয়েছেন। কোনো টাকা দিতে হয়নি।
২০১৬ সালের জুনে ‘হ্যারিয়ার’ নামে ৭৬ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কিনেন মোকাররম। তবে তিনি বলেন, এত নয়, ২৮ লাখ টাকা দিয়ে পুরনো একটি গাড়ি কিনেছি। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কিশোরগঞ্জ শহরের উকিলপাড়া এলাকায় ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা দিয়ে তিনতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি কিনেন তিনি।
এ বাড়ির বিষয়ে মোকাররম বলেন, ‘এত টাকা নয়, ৯৩ লাখ টাকা দিয়ে জমিসহ বাড়িটি কিনেছি।’ একই বছরে নিজ গ্রামে ৩০ শতাংশ জমিতে বাবা নুরুল ইসলামের নামে একটি মডেল কলেজ করেছেন মোকাররম।
কলেজ সম্পর্কে মোকাররম বলেন, ‘গ্রামে জমির দাম কম। তাই ৩০ শতাংশ জমিতে বাবার নামে নুরুল ইসলাম মডেল কলেজ করে দিয়েছি। কলেজটি আমার ছোটভাই দেখভাল করে। আমি ওই কলেজের চেয়ারম্যান।’
ফতুল্লায় শ্রমিক লীগ নেতার ছত্রছায়ায় থেকে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলীতে বিএনপি’র কমিটিতে থাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে মোকাররম বলেন, ‘এটি মিথ্যা এবং বানোয়াট কথা। আমি রাজনীতি করি না।’
এ বিষয়ে নিকলী থানা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুল মোমেন মিঠু বলেন, ‘মোকাররমকে আমি আগে চিনতাম না। দু’বছর আগে স্থানীয় কিছু নেতাকর্মীদের নিয়ে মোকাররম আমার কাছে এসে বিএনপির রাজনীতি করবে বলে জানায়। স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমার কাছে তদবির করে বলেন, মোকাররম এলাকায় টাকা-পয়সা খরচ করে।
দলের দুর্দিনে নেতাকর্মীদের টাকা-পয়সা প্রয়োজন। মোকাররমের মতো একজন নেতা থাকলে দলের জন্য উপকার হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের এসব কথা শুনে আমি রাজি হলাম। এরপর জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে মোকাররমকে নিকলী থানা বিএনপির কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে পদ দিয়েছি।
পদ পাওয়ার পর থেকে মোকাররম আমার সঙ্গে ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেয় না। তবে গ্রাম থেকে তার লোকজন দলীয় কর্মসূচিতে আসে।’
বদরুল মোমেন মিঠু জানান, মোকাররম গত বছর ঈদে হেলিকপ্টারে গ্রামের বাড়ি এসেছিল। এর আগে সে স্পিট বোট নিয়ে এসেছিল। গ্রামে সচরাচর কেউ এভাবে আসে না।
মোকাররমের হঠাৎ পরিবর্তনে এলাকাবাসীর মধ্যে চাঞ্চল্য দেখেছি। এলাকাবাসীর কাছ থেকে শুনেছি মোকাররম লেবার সর্দার। কিন্তু একজন লেবার সর্দার অল্প সময়ে এত ধন-সম্পদের মালিক হয় কীভাবে?
এ বিষয়ে মোকাররমের বক্তব্য হল, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলীগঞ্জ একটি বাড়িতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস করি। আগে লেবার ছিলাম, এখন লেবারদের সর্দার। বিভিন্ন কোম্পানির মাল লোড-আনলোডের কন্টাক্ট নিই। এতে লেবার খাটিয়ে যা পাই, তা দিয়েই চলি।
সুত্র: যুগান্তর।