নিজস্ব সংবাদদাতা : বছর ঘুরে আবার আসছে ঈদুল ফিতর। কিশোরগঞ্জে ঈদ মানেই শোলাকিয়ায় লাখো মুসল্লির জামাত। তবে গত দুটি বছর করোনার কারণে ছন্দপতন। ঈদ ছিল, কিন্তু ছিল না শোলাকিয়ার জামাতের আয়োজন।
এ নিয়ে মানুষের মনে ছিল বিস্তর আক্ষেপও। এবার ঘুচবে সেই আক্ষেপ। ঈদে লাখো মুসল্লির পদভারে মুখরিত হবে শোলাকিয়ার মাঠ। চলছে সেই প্রস্তুতি। দিন-রাতের পরিশ্রমে নামাজের উপযোগী হয়ে উঠছে প্রিয় ঈদগাহ ময়দান। আয়োজনের তোড়জোড় দেখে খুশি এলাকাবাসী।
শোলাকিয়া মসজিদের ইমাম মো. গোলাপ মিয়া বলেন, দু’ই বছর পর শোলাকিয়ায় জামাত হচ্ছে, এ জন্য মুসল্লিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশি। এবার হয়তো লোকজনের উপস্থিতি সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। শোলাকিয়ার বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন মাঠে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের কাজকর্ম দেখছিলেন। তিনি বললেন, প্রায় দুই শ বছরের ইতিহাসে কোনো দুর্যোগে বন্ধ থাকেনি শোলাকিয়ার ঈদ জামাত। তবে করোনার কারণে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। আশা করছি, আর কোনো দিন বন্ধ থাকবে না এই জামাত।
করোনা বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল হওয়ায় শোলাকিয়ার ঈদ জামাত আয়োজনে তোড়জোড় চলছে। এটি হবে ঈদুল ফিতরের ১৯৫তম জামাত। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত আয়োজন উপলক্ষে এখন ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়ায় চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। তবে এ আয়োজনে এবার নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে।
সরেজমিনে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে দাগ কাটা, বালু ফেলা, দেয়াল রঙ করার কাজ শেষ হয়েছে। সংস্কার হয়েছে ওজুখানা ও টয়লেট। চলছে বিদ্যুতের লাইন টানার কাজ। সিসি ক্যামেরাগুলো কোথায় বসবে, দেখছে সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে চলছে শহরের শোভাবর্ধনের কাজও। সব মিলিয়ে শোলাকিয়া ঘিরে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ কিশোরগঞ্জ শহরজুড়ে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, দূর-দূরান্তের মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য শোলাকিয়া স্পেশাল নামে দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থাও করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। জামাত শুরু হবে সকাল ১০টায়। এতে ইমামতি করবেন বাংলাদেশ ইসলাহুল মুসলেমিন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটি জানিয়েছে, এবার নিরাপত্তাকে দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। জামাতের প্রস্তুতি ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টরা বারবার পরিদর্শন করছেন ঈদগাহ মাঠ। বসছেন দফায় দফায় বৈঠকে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শামীম আলম জামাতে নিরাপত্তার বিধিবিধানগুলো সবাইকে মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শোলাকিয়ায় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর জামাত না হলেও এবার জামাত হবে। মাঠে থাকবে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। তাই টুপি, জায়নামাজ ও মাস্ক ছাড়া আর কিছুই মাঠে নেওয়া যাবে না। ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও ছাতাও বাড়িতে রেখে যেতে হবে। এ সময় তিনি নিরাপদ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নামাজ আয়োজনে সবার সহযোগিতা চান।
২০১৬ সালে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়েছে চার স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রত্যেক মুসল্লি বেশ কয়েকবার হবেন তল্লাশির মুখোমুখি। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে পুরো মাঠ ও আশপাশ। নিরাপত্তাব্যবস্থার বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, এবার অনেক বেশি লোক হবে শোলাকিয়ায়। তাই সব বিষয় মাথায় রেখে এবার আমরা বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
নামাজের সময় পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব, আনসার সদস্যের সমন্বয়ে নিরাপত্তা বলয়ের পাশাপাশি মাঠে সাদা পোশাকে নজরদারি করবে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। থাকবে ফায়ার ব্রিগেড, ছয়টি অ্যাম্বুল্যান্সসহ মেডিক্যাল টিম, পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম তৈরি থাকবে, পুরো মাঠ বেশ কয়েকবার মাইন ডিটেক্টর দিয়ে সুইপিং করা হবে, ঢাকা থেকে বম্ব ডিসপোজাল টিম আসবে, এ ছাড়া মাঠসহ প্রবেশপথগুলোতে থাকছে সিসি ক্যামেরা ও ওয়াচ টাওয়ার। আর আকাশে উড়বে পুলিশের ড্রোন ক্যামেরা। অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থায় বিরক্ত না হয়ে সবাইকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান পুলিশ সুপার।
কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, পৌরসভার পক্ষ থেকে এরই মধ্যে শহর ও মাঠকে সুন্দর করে সাজানো, মাঠকে নামাজের উপযোগী করে তোলা, মুসল্লিদের জন্য সুপেয় পানি, দূর-দূরান্তের মুসল্লিদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নানা আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। এককথায়, শোলাকিয়ায় আগত মুসল্লিদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হবে পৌরসভার পক্ষ থেকে।
রেওয়াজ অনুযায়ী, জামাত শুরুর আগে ছোড়া হয় বন্দুকের ৬টি ফাঁকা গুলি। নামাজের ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি গুলি ছুড়ে নামাজ শুরুর সংকেত দেওয়া হয়।
জনশ্রতি আছে, ১৮২৮ সালে এই মাঠে ঈদের জামাতে সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছিলেন। সেই থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখিয়া’। যা এখন শোলাকিয়া নামেই পরিচিত।