কামার ফরিদ : মাদক ও মাদকতা। একটি দ্রব্য হলে অপরটি দ্রব্যগুণ। মাদক নির্দিষ্ট বৃত্তে সীমাবদ্ধ, মাদকতার ব্যাপ্তি সর্বত্র। দ্রব্য হিসেবে মাদকের পরিচিতি ব্যাপক। তবে গ্রহণযোগ্যতা ততটা নয়। আর মাদকতার গ্রহণযোগ্যতার যেন শেষ নেই। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়—প্রকৃতিতে এমন কিছুই নেই যে, যার মাঝে মাদকতার গন্ধ নেই। প্রকৃতির প্রতিটি স্তরেই এর বসবাস। একজন নারীর মাঝে পুরুষ যেমন মাদকতার সন্ধান করে, একজন নারীও পুরুষের মাঝে তা খুঁজে পায়।
অনেক সময় মাদকতাকে আমরা ঘোর হিসেবে আখ্যায়িত করি। এই ‘ঘোর’ শব্দটিই আজ বিশ্বকে সভ্যতার বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। সম্ভবত শব্দটির উপস্থিতি না থাকলে সভ্যতার জন্ম অসম্ভব হয়ে পড়ত। ভাষা এবং বই—দুটিই সভ্যতার বাহন। এই বাহন দুটি যে ঘোরের জন্ম দিয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা মানবজাতির সাধ্যের বাইরে। আর মানবজাতির অংশ হিসেবে পাঠকের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমানভাবেই প্রযোজ্য।
একজন লেখক, কবি বা সাহিত্যিকের জন্য এই মাদকতা নির্মাণ—অন্যতম প্রধান কাজ। আর এই মাদকতা তৈরি করতে প্রয়োজন হয়, শব্দের ব্যবহার, বাক্য গঠন, ভাষার ক্ষিপ্রতা, চিত্রকল্প-উপমা-রূপক ও কাহিনিবিন্যাস।
টেবিলে পড়ে আছে একটি বই। দিন তিনেক আগে পাঠ শেষ করেছি। তবে, পাঠপর্ব শেষ করেছি বললে ভুল বলা হবে। প্রকৃত অর্থে এখনো শেষ হয়নি। কেননা গ্রন্থটি যে পরিমাণ মাদকতা ছড়িয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা এখনো সম্ভব হয়নি। ঘোরটা এখনো ধরে রেখেছে পাঠককে। আর এখানেই লেখকের সার্থকতা।
মোট ১২টি গল্পের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে গ্রন্থটির অবয়ব। লেখক নিজেই বলেছেন, এটি ভ্রমণগল্প। আমিও তার সঙ্গে একমত। ভ্রমণকাহিনি নয়—গল্প। কাহিনি আর গল্পের মাঝে কিছুটা ব্যবধান আছে। কাহিনি অনেকটা ধারাভাষ্যের মতো। গল্প তা নয়। লেখক তার ১২টি রচনাকে গল্পের অবয়বে নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। তবে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া ছোটগল্পের সংজ্ঞা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ অনুসরণ করতে পারলে বোধহয় পুরো গ্রন্থটি আরো সুখপাঠ্য হয়ে উঠতে পারত।
শব্দের ব্যবহার, বাক্যগঠন, ভাষার ক্ষিপ্রতা, চিত্রকল্প-উপমা-রূপক ও কাহিনিবিন্যাসে লেখক যে পরিশ্রম করেছেন—তা পরিমাপ করে বলা না গেলেও তাকে অভিনন্দন জানানো যায়। বিশেষ করে ইতিহাসের ওপর নির্ভরতা এবং প্রয়োগ গ্রন্থটিকে তার মেরুদণ্ডের ওপর শক্ত করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।
এ গ্রন্থের আলোচনা এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না। লেখককে আত্মপক্ষ সমথর্নের সুযোগটা দিতেই হচ্ছে। বইয়ের ফ্ল্যাপে তিনি বলেছেন, সরেজমিন অভিজ্ঞতাই গ্রন্থের কাঠামো। তাতে মিশ্রিত হয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য আর সভ্যতার ছিঁটেফোঁটা।
লেখক সত্যই বলেছেন। পাঠক এসব উপাদান নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাবেন গ্রন্থটিতে।
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে তোলা মহাতীর্থগুলোকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপন করেছেন জাকারিয়া মন্ডল। গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে তুলে ধরেছেন বহুমাত্রিক আবেদনে। নেপালের অধিষ্ঠাতা দেবতা মেসন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের মানুষরূপে। রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেছেন ত্রিপুরায়, গোমতীর বাঁকে ভুবনেশ্বরীতে। দক্ষিণ ত্রিপুরার পিলাক ঘুরে মিল পেয়েছেন বাংলাদেশের ময়নামতি আর পাহাড়পুরের সঙ্গে। ত্রিপুরেশ্বরীর বোষ্টমি আর চট্টগ্রামের বোস্তামি কচ্ছপকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছেন পর্যবেক্ষণজাত অভিজ্ঞতায়। সুদূর বাহরাইনে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছেন হারিয়ে যাওয়া দিলমুন সভ্যতার বুকে। গেঁথেছেন বোর্নিও দ্বীপের আত্মা উপাসক মুসলমান আদিবাসী সম্প্রদায়ের অজানা গল্পের মালা।
পাহাড়ের ভাঁজে মাহকাব্য গ্রন্থটিতে এমন অনেক অপ্রলচিত গল্পের ছড়াছড়ি। এসব বিষয় পাঠকের রসবোধের মাত্রাকে বহুমাত্রিকতায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে।
পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য, জাকারিয়া মন্ডল, প্রকাশক :শুদ্ধপ্রকাশ, ২০১৯
দাম :২৫০ টাকা