নিজস্ব সংবাদদাতা : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশনে তুর্ণা নিশিথা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অর্ধ শতাধিক। এরই মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
নিহতদের মধ্যে ছিল মাত্র ৩ বছরের শিশু ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ছোঁয়া মনি। যে কিনা এখনও মায়ের কোল ছেড়ে পৃথিবীকেই দেখে উঠতে পারেনি। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগেও মা আর বাবার কোলে ঘুমিয়ে ছিল নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে।
মা-বাবাকে সামনে না দেখলে জুড়ে দিতো ছোঁয়া। বাবা-মাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকত না সে। অথচ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সে নিজেই মা-বাবাকে ছেড়ে চলে গেল।
সোমবার ট্রেনে চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাবা-মার সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে আসছিল ছোঁয়া মনি। ভোর রাতে মন্দবাগে মর্মান্তির ট্রেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন ছোঁয়া মনির বাবার সোহেল মিয়া ও মা নাজমা বেগম। আহত হয়েছিল তাদের কোলে থাকা শিশু সন্তান ছোঁয়া মনিও।
তাদের তিনজনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যান উদ্ধারকারীরা। কিন্তু এত বড় দুর্ঘটনার ধকল সইতে পারেনি এত ছোট শরীরের ছোঁয়া মনি। হাসপাতালে নেয়ার আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায় এই ক্ষণজন্মা।
এদিকে সন্তানের লাশ ফেলেই দূরে সরে যেতে হয় মা-বাবাকে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে অ্যাম্বুলেন্সে করে ছোঁয়া মনির কাছ থেকে শত মাইল দূরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আনা হয় তাদের। আর ছোঁয়া মনির নিথর দেহ পড়ে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের লাশঘরে।
সোহেল ও নাজমাকে নিয়ে যখন ঢাকায় যাওয়া হচ্ছিল তখন ছোঁয়া মনির মামা জামাল মিয়া ভাগ্নির লাশ বুঝে নিতে হাসপাতালের মর্গ আর পুলিশের কাছে দৌড়াদৌড়ি করছেন।
কাঁদতে কাঁদতে জামাল মিয়া জানিয়েছেন, ছোঁয়া মনির শরীরে ছুড়ি কাঁচি চালাতে দিতে চাই না আমি। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ময়নাতদন্ত ছাড়া বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
এজন্য মঙ্গলবার সকালেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন।
তাতে লিখেছেন, ‘আপনার বরাবরে এই মর্মে আবেদন করিতেছি যে, আমার অধুনামৃত ভাগ্নি ছোঁয়া মনি, বয়স অনুমান ৩ বৎসর, পিতা: সোহেল মিয়া, মাতা: নাজমা বেগম, গ্রাম: বানিয়াচং, পোস্ট বানিয়াচং, থানা বাহিনয়াচং, জেলা: হবিগঞ্জ অদ্য ১২ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোর অনুমান ৪ ঘটিকার সময় মন্দবাগ রেলস্টেশনে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হইলে আমার ভাগ্নি ছোঁয়া মনিকে উদ্ধার করিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার ভাগ্নি ছোঁয়া মনিকে মৃত বলিয়া ঘোষণা করেন। বর্তমান আমার অধুনামৃত ভাগ্নির লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের মর্গে আছে। এ ব্যাপারে আমাদের পরিবারের পক্ষ হইতে আমার ভাগ্নির মৃত্যুর ব্যাপারে কোন অভিযোগ নাই বা কোনো প্রকার মামলা মোকদ্দমা করিব না বলিয়া আমিসহ আমার পরিবারের লোকজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইতেছি।’
ছোঁয়া মনি ছাড়া এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আরো নিহতরা হলেন যারা-চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের পশ্চিম রাজারগাঁওয়ের মুজিবুর রহমান (৫৫), হবিগঞ্জের ভোল্লার ইয়াছিন আরাফাত (১২), চুনারুঘাটের তিরেরগাঁওয়ের সুজন আহমেদ (২৪), মৌলভীবাজারের জাহেদা খাতুন (৩০), চাঁদপুরের কুলসুম বেগম (৩০), হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের আল-আমিন (৩০), হবিগঞ্জের আনোয়ারপুরের আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের আদিবা (২), চাঁদপুরের উত্তর বালিয়ার ফারজানা (১৫), চাঁদপুরের হাইমচরের কাকলী (২০), হবিগঞ্জের রিপন মিয়া (২৫), চাঁদপুরের হাইমচরের মরিয়ম (৪), নোয়াখালীর মাইজদির রবি হরিজন (২৩), চাঁদপুর সদরের ফারজানা (১৫), হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের পিয়ারা বেগম (৩২)।
জেলা সিভিল সার্জন শাহ আলম জানান, দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন বেশ কয়েকজন। এর আগে তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এ ছাড়া কুমিল্লা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), সদর হাসপাতাল, আখাউড়া এবং কসবা উপজেলা হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।