সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / হাওরাঞ্চল / কিশোরগঞ্জ / দেড় কোটি টাকার সিংহভাগ লোপাট

দেড় কোটি টাকার সিংহভাগ লোপাট

সাইফুল হক মোল্লা দুলু, কিশোরগঞ্জ ও হারুন চৌধুরী, কুলিয়ারচর :

বলতে গেলে চালও নেই, চুলোও নেই। এ রকম অবস্থার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিল্ডিং মেরামতের জন্য সরকারি অর্থের এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের সরকারি বরাদ্দের টাকা ৭৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এভাবেই ব্যয় দেখানো হয়েছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলায়।

সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, কুলিয়ারচর উপজেলায় বিগত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের জন্য বিভিন্ন খাতে উপজেলার ৭৪টি বিদ্যালয়ে দেড় কোটির টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিদ্যালয়গুলোর ক্ষুদ্র্র মেরামত, স্লিপ, প্রাক-প্রাথমিক ওয়াশব্লক, রুটিন মেইনটেন্যান্সের জন্য ওই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। পর্যায়ক্রমিক দুর্নীতির কারণে ওই বরাদ্দের টাকা যথোপযুক্ত ব্যবহার হয়নি।

জানা যায়, বৃহৎ মেরামত কাজের জন্য উপজেলার ২৩টি বিদ্যালয়ে দুই লাখ এবং ক্ষুদ্র মেরামত কাজের জন্য ২৪টি স্কুলে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা ছাড়া রুটিন মেইনটেন্যান্সে ৫০টি স্কুলে ৪০ হাজার টাকা করে, সব স্কুলে প্রাক-প্রাথমিকে ১০ হাজার টাকা, ওয়াশ ব্লক সিঙ্গেল ১০ হাজার টাকা, ডাবল ২০ হাজার টাকা, স্লিপে সব স্কুলে ছাছাত্রী অনুপাতে ৪০-৮৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যেসব বিদ্যালয় নতুন বিল্ডিংয়ের বরাদ্দ পেয়েছে, সেসব বিদ্যালয় সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দ পেতে পারে না। তবে শিক্ষা অফিস নিয়ম-বহির্ভূতভাবে উপজেলার মাতুয়ারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফরিদপুর আলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমোদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নলবাইদ মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভিটিগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ৯টি বিদ্যালয়কে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মেরামত কাজের বরাদ্দের অন্তর্ভুক্ত করে।

উপজেলার ৫৪নং মাতুয়ারকান্দা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামত কাজের জন্য দেড় লক্ষ টাকা, প্রাক-প্রাথমিকে ১০ হাজার, স্লিপে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিল্ডিং না থাকার পরও মেরামতের টাকা কোথায় খরচ করা হয়েছে জিজ্ঞেস করা হলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুনা আক্তার বলেন, ‘ক্ষুদ্র মেরামতের দেড় লাখ টাকা থেকে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা ভ্যাট কর্তন করা হয়েছে। বাকি টাকা দিয়ে বিদ্যালয়ের টিনশেড তৈরি এবং মাটি ভরাট বাবদ খরচ করা হয়েছে।’

মোজরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ. কুদ্দুসসহ

একাধিক সভাপতি বলেন, স্কুলের কাজ কতটুকু হয়েছে জানি না। তবে শিক্ষা অফিসারের কথামতো

চেকে অগ্রিম স্বাক্ষর করেছিলাম।’

উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, রঙের প্রলেপ দিয়ে ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দ জায়েজ করা হয়েছে। আসবাবপত্র ক্রয়েও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষা অফিসারের পছন্দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক বিদ্যালয় প্রধানদের এসব সামগ্রী ক্রয় করতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নিম্নমানের আসবাব সামগ্রী ক্রয় করা হলেও চড়ামূল্যের ভাউচার তৈরি করা হয়েছে।

বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলনেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরাদ্দকৃত টাকা সংশ্নিষ্ট বিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাউন্টে সরাসরি জমা হওয়ার বিধান থাকলেও উপজেলা শিক্ষা অফিসের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। খাতওয়ারি বরাদ্দে ভ্যাট, অডিট খরচ ও উৎকোচের আঁচড় লাগানো হয়েছে।

গত এক সপ্তাহ অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রধান শিক্ষক এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, অন্যরা ঘুষ দিয়ে বিলের টাকা তুলে নিলেও আমি ঘুষ দিতে না পারায় বিদ্যালয় মেরামতের কাজ সুন্দরভাবে শেষ করেও বিল পাচ্ছি না।’

অন্য একটি বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের বরাদ্দ থেকে ৩০ হাজার টাকা ভ্যাট কর্তন করা হয়েছে। অডিট ও অফিস খরচ (উৎকোচ) রয়েছে এর বাইরে।’

শিক্ষা অফিস ও প্রকৌশল অফিস বিদ্যালয়গুলো থেকে এভাবে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিলেও এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুলছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, অডিট খরচ বাবদ প্রাক-প্রাথমিকে ৫০০ থেকে এক হাজার, রুটিন মেইনটেন্যান্স চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, স্লিপ ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, ওয়াশ ব্লক এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা এবং মেরামত কাজের জন্য ১০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন ফারুকী জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র উন্নয়ন কাজের সমুদয় অর্থ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ তার সঙ্গে জড়িতরা কার্যত লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এমন অনিয়ম-দুর্নীতির নজির এর আগে হয়নি। সারা জেলার ১৩টি উপজেলার অর্থ বরাদ্দ এবং কাজ না করে টাকা মেরে দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, অভিযুক্ত শিক্ষা কর্মকর্তা বর্তমান কর্মস্থলে বহাল থাকলে তাদের কেউ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কথা বলবে না। কারণ প্রকাশ্যে কথা বললে তাদের নানা হয়রানির শিকার হতে হবে।

এসব ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার সৈয়দ আবুল খায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অনিয়মের কোনো বালাই নেই। যার যার অ্যাকাউন্টে ক্রস চেক দেওয়া হয়েছে।’ ভ্যাট ও অডিট খরচের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, ‘আপনার কিছু জানার থাকলে ইউএনও স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

কুলিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাউসার আজিজ বলেন, ‘পুরো টাকা মেরে দেওয়া হয়েছে, এ কথা সত্য নয়। তা ছাড়া অর্থ কিংবা কমিটি কোনোটার সঙ্গেই ইউএনও সম্পর্কযুক্ত নয়। কারণ বরাদ্দকৃত অর্থের চেকে ইউএনওদের স্বাক্ষরের নিয়ম ছিল না। তবে বলা যায়, বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশেরই কাজ হয়নি। টাকা নয়ছয় হয়েছে। যেহেতু সংবাদপত্র কিংবা মিডিয়ার মাধ্যমে অভিযোগটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার পর্যন্ত এসেছে, তাই আমি তা তদন্ত করে দেখব। কাজ যারা করেনি, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *