সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / খেলাধুলা / মুশফিক বীরত্বে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়

মুশফিক বীরত্বে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়

হাওর বাংলা ডেক্স : সিঙ্গেল নিয়ে দলকে জিতিয়ে দু হাত উঁচিয়ে হুংকার ছুঁড়লেন মুশফিকুর রহিম। প্রায় ৩০ হাজার দর্শকে ভরা গ্যালারি স্তব্ধ। সেই নীরবতায় মুশফিকের গর্জন আরও তীব্রভাবে ছড়িয়ে গেল চারপাশে। এ যেন হারের বলয় ভাঙার চিৎকার। দুঃসময়কে পাল্টা জবাব দেওয়ার চিৎকার। অসাধারণ এক জয়ের আনন্দ-চিৎকার। ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে জেতালেন মুশফিক।  ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে রান তাড়ার ইতিহাস গড়ে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। শনিবার ছুটির দিনে প্রেমাদাসার বাদ্য-বাজনা আর উৎসব থামিয়ে বাংলাদেশ জিতেছে ৫ উইকেটে।

দুই দলের সবশেষ লড়াইয়ে মাত্র কদিন আগেই ২১০ রান তুলেছিল শ্রীলঙ্কা। এবার সেটিকে ছাড়িয়ে তারা তোলে ২১৫ রান। আগে কখনোই ১৬৪ রানের বেশি তাড়া করে জেতেনি বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক দুঃসময়ও খুব বেশি আশার আলো দেখায়নি। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলের তো সামনে এগোনো ছাড়া উপায় নেই! অবিস্মরণীয় রান তাড়ায় বাংলাদেশ জিতল ২ বল বাকি রেখে।

বিস্ফোরক শুরুতে দলকে জয়ের বিশ্বাস জুগিয়েছিলেন তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। বাকিটুকু মুশফিকের অনন্য ব্যাটিংয়ের গল্প। বীরোচিত ব্যাটিংয়ে দলকে জিতিয়ে রচনা করলেন নতুন এক অধ্যায়ের। শেষ কয়েক ওভার পায়ে ক্র্যাম্প নিয়ে খেলেছেন। খুঁড়িয়েছেন। কিন্তু এ দিনের মুশফিক যেন হার মানতে জানেন না!

বড় রান তাড়ার প্রথম শর্ত দারুণ শুরু। বাংলাদেশ শুরু থেকেই এগিয়েছে শ্রীলঙ্কার রানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। শ্রীলঙ্কা পঞ্চাশ স্পর্শ করে ৩.৫ ওভারে। বাংলাদেশের লাগে মাত্র দুই বল বেশি। পাওয়ার প্লে শেষ হতে হতে এগিয়ে যায় বাংলাদেশই। ৬ ওভারে শ্রীলঙ্কার রান ছিল ১ উইকেটে ৭০, বাংলাদেশের ১ উইকেটে ৭৪।

এগিয়ে থেকেই বাংলাদেশ পা রাখে তিন অঙ্কের সীমানায়। ৯.২ ওভারে আসে একশ, লঙ্কানদের শতরান ছিল ১০.২ ওভারে। দেড়শতেও বাংলাদেশ এগিয়েছিল এক ওভার। অতীতে কাছে গিয়ে পথ হারানোর গল্প অনেক আছে। এদিন শেষেও এগিয়ে বাংলাদেশই।

সম্ভবত ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশনের কথা ভেবেই তামিম ইকবালের সঙ্গে ওপেনিংয়ে পাঠানা হয় লিটন দাসকে। কারণ যেটিই থাকুক, কাজে লেগে যায় দারুণভাবে। দলকে বিশাল রান তাড়ার পথে এগিয়ে নেয় এই জুটি। স্কোরবোর্ডে দুজন এনে দেন কাঙ্ক্ষিত ভিত, ড্রেসিং রুমে ছড়িয়ে দেন আত্মবিশ্বাস, প্রতিপক্ষকে ফেলে দেন চাপে।

লিটন শুরুটায় একটু ছটফটে থাকলেও পরে খেলেছেন দারুণ সব শট। তিনি ছন্দে থাকলে যেমন খেলেন, যথারীতি ছিলেন তেমন স্টাইলিশ। যথারীতি ফ্লিক শটগুলো ছিল দৃ্ষ্টিনন্দন। তামিম চেনা চেহারায়।

 

৫ ছক্কায় ১৯ বলে ৪৩ করে লিটন আউট হন নুয়ান প্রদিপের স্লোয়ারে। ততক্ষণে রান হয়ে গেছে ৭৪। গত বছর এই মাঠেই সৌম্য ও ইমরুলের ৭১ রান ছাড়িয়ে বাংলাদেশের সেরা উদ্বোধনী জুটি।

দলকে একশতে নিয়ে গেয়ে আউট হন তামিম। ফিফটি পাননি তিনিও। ২৯ বলে ৪৭ বলে ফিরতি ক্যাচ দেন থিসারা পেরেরাকে। গত ১৩টি টি-টোয়েন্টিতে তার সর্বোচ্চ স্কোর এটি।

তিনে নামা সৌম্যর শুরুটা ছিল নড়বড়ে। তবে উইকেট ছুঁড়ে আসেননি। আরেক পাশে মুশফিক শুরু থেকেই ছিলেন দুর্দান্ত। মাঝে-মধ্যে সৌম্য মেরেছেন বাউন্ডারি। বাংলাদেশ তাই পেয়ে যায় আরেকটি অর্ধশত রানের জুটি।

২২ বলে ২৪ করে সৌম্য ফিরেছেন। ১১ বলে ২০ রানের কার্যকর ইনিংস খেললেও কাজ শেষ করে আসতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। শেষের আগের ওভারে রান আউট সাব্বির। দলের ভরসা ছিল কেবল সেই মুশফিকই।

বেঙ্গালুরুর স্মৃতি উঁকি দিয়েছে অনেকের মনে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে হাতের মুঠো থেকে জয় ফেলে দিয়েছিলেন মুশফিক। এবার কোনো ভুলের পথে পা নয়। শেষের আগের ওভারে প্রদিপকে ছক্কা মেরে সমীকরণ নিয়েছেন ৬ বলে ৯ রানে।

শেষ ওভারের প্রথম বলে দুই, পরের বলে দারুণ বাউন্ডারি। পরের বলে আবার দুই। এরপর সিঙ্গেলে জয়। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে ৩৫ বলে ৭২ রানে অপরাজিত মুশফিক। সম্ভবত টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সবসময়ের সেরা ইনিংস।

ম্যাচের প্রথম ভাগে এই দলই ছিল বিবর্ণ। আগর ম্যাচে বোলিং ভালো হলেও এদিন ছিল এলোমেলো, একদম ধারহীন।

তাসকিন আহমেদের করা প্রথম ওভারেই কুসল মেন্ডিসের ব্যাটে চার ও ছক্কা। দুটির একটিও অবশ্য মাঝ ব্যাটে নয়। তবে খুব দ্রুতই ব্যাটের মাঝ থেকে বল ছুটতে থাকে প্রেমাদাসার নানা প্রান্তে।

মুস্তাফিজের করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার থেকে ১১। তৃতীয় ওভারে রুবেল হোসেন চার দিয়ে শুরু করেও দেন মাত্র ৬ রান। সেটি পুষিয়ে দিতেই যেন পরের ওভারে উদার হয়ে এগিয়ে আসেন তাসকিন। ওই ওভার থেকে আসে ২২।

২৭ বলে ৫৬ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন মুস্তাফিজ। দারুণ কাটারে বোল্ড ১৯ বলে ২৬ রান করা গুনাথিলাকা।

সেটি ছিল কেবলই ক্ষনিকের স্বস্তি। হাওয়া আবারও বৈরি হয়ে ওঠে দুই কুসলের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে।

স্পিন আক্রমণে আসার পর একটু ভাটার টান ছিল রানের স্রোতে। ৩ ওভারে রান আসে ১৬। তবে সেটি ছিল যেন ঝড়ের আগের শান্ত পরিস্থিতি। আবার উত্তাল হয়ে ওঠে দুজনের ব্যাট।

২৪ বলে কুসল মেন্ডিস স্পর্শ করেন ফিফটি। তার ক্যারিয়ারের তৃতীয়। তিনটিই বাংলাদেশের বিপক্ষে, টানা তিন ম্যাচে।

সপ্তম বোলার হিসেবে আক্রমণে এসে এই জুটি ভাঙেন মাহমুদউল্লাহ। শুরুটা যদিও ছিল বাজে। প্রথম বলটি ছিল শর্ট, মেন্ডিস ফেলেন গ্যালারিতে। পরের চার বলেই তুলে নেন দুই উইকেট।

৫ ছক্কায় ৩০ বলে ৫৭ করে আউট কুসল মেন্ডিস। ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া দাসুন শানাকা শূন্য। দুজনই ধরা মিড উইকেটে সাব্বিরের হাতে।

আরেকটি খরুচে বোলিংয়ের ম্যাচে তাসকিনকে সান্ত্বনার উইকেট উপহার দিয়ে যান দিনেশ চান্দিমাল। তাতে শ্রীলঙ্কার ক্ষতি খুব একটা হয়নি। কুসল পেরেরা ছিলেনই। শেষের দাবি দারুণভাবে মেটান উপুল থারাঙ্গাও।

৪৮ বলে ৭৪ রান করে পেরেরা আউট হন শেষ ওভারে। থারাঙ্গা অপরাজিত ১৫ বলে ৩২ রানে। শেষ ওভারে জিবন মেন্ডিসের ছক্কায় বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের আগের সর্বোচ্চ ছাড়িয়ে যায় শ্রীলঙ্কা।

সর্বোচ্চ ছিল সেটা এই মাঠেরও। কে জানত, ঘণ্টা দেড়েক পরই সেই স্কোর পড়ে যাবে পেছনে! নতুন ইতিহাস রচনা করেই যেন দুঃসময়ের ঘুরপাক থেকে বের হতে চেয়েছিল বাংলাদেশ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ২১৪/৬ (গুনাথিলাকা ২৬, মেন্ডিস ৫৭, পেরেরা ৭৪, শানাকা ০, চান্দিমাল ২, থারাঙ্গা ৩২*, থিসারা ০, জিবন ৬*; তাসকিন ১/৪০, মুস্তাফিজ ৩/৪৮, রুবেল ০/৪৫, মিরাজ ০/৩১, নাজমুল ০/২০, সৌম্য ০/১১, মাহমুদউল্লাহ ২/১৫)

বাংলাদেশ: ১৯.৪ ওভারে ২১৫/৫ (তামিম ৪৭, লিটন ৪৩, সৌম্য ২৪, মুশফিক ৭২*, মাহমুদউল্লাহ ২০, সাব্বির ০, মিরাজ ০*; চামিরা ১/৪৪, দনঞ্জয়া ০/৩৬, প্রদিপ ২/৩৭, গুনাথিলাকা ০/২২, থিসারা ১/৩৬, অজন্তা ০/২৫, শানাকা ০/১২)

ফল: বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *