সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / মতামত / কুকরি মুকরির বন সাগরে

কুকরি মুকরির বন সাগরে

জাকারিয়া মন্ডল : কচ্ছপিয়া ঘাটে বিকাল সাড়ে চারটাতেও শরীর তাতানো রোদ। দিনের শেষ ট্রলারটা নোঙর তোলার ভেঁপু ছাড়ছে। টালমাটাল জলে দক্ষিণে নাক ঘোরাল স্পিডবোট। ছুটতে শুরু করতেই সূর্যটাকে আড়াল করে দিল উঁচু উঁচু গাছের সারি।

অপ্রশস্ত খালটায় শীত শীত আমেজ। পশ্চিমে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে সরু সরু রোদের রেখা। বিপরীত পাড়ের গাছসারিতে অদ্ভূত আলোর আসন। সবুজ পাতায় রোদমাখা মায়া।স্পিডবোটের পেছনে ঢেউ ভাঙ্গছে দুপাড়ে। ইঞ্জিনের আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে পানির গান।

গাছের সারি শেষ হতেই নদীর অবয়ব নিল কচ্ছপিয়া খাল। পশ্চিমে পাড়ের মাত্র কয়েক ফুট উপরে ঝুলে এসেছে সূর্যটা। পানিতে তার পূর্ণ প্রতিবিম্ব। ঢেউয়ের দোলায় ভাঁজ খেতে খেতে দুলছে। পাড় ধরে মহিষের পাল নিয়ে ডেরায় ফিরছে রাখাল। পূর্বে লক্ষ্মী-পক্ষীর চরে পানির কিনারা ছুঁয়ে এক সারি বক। নীড়ে ফেরার আগে দিনের শেষ শিকারের অপেক্ষায়।

কুকরি মুকরির পথে সঙ্গী হবে এমন বকের ঝাঁক। ছবি: খন্দকার হাসিবুজ্জামান

দুই চরের ফাঁক গলে কচ্ছপিয়া খাল থেকে মেঘনার শাখা খালে বেরিয়ে এল বোট। পূর্ব দিক থেকে মেঘনার সঙ্গ ছেড়ে একটি ধারা এখানে এগিয়ে এসেছে পশ্চিমে। এই ধারার সঙ্গে মিলিত হয়েছে পশ্চিম থেকে তেতুলিয়ার সঙ্গ ছেড়ে আসা একটি ধারা। দুই ধারা মিলে দক্ষিণে ছুটেছে বঙ্গোপসাগরের পানে। এই মিলিত ধারা আর মেঘনার বেড়ে শুয়ে থাকা বঙ্গোপসাগরমুখি দ্বীপটাই চর কুকরি মুকরি। একসময় প্রচুর কুকুর ও মেকুর বা ইঁদুর ছিল বলেই নাকি এ চরের নাম কুকরি মুকরি দিয়েছিল সাহেবরা।

এখানে খালটা বেশ প্রশস্ত। উত্তরপাড়ের অনুচ্চ জমিতে লথুর মুড়া আর কাজলা ধান। স্থানীয় জাতের নোনা পানি সহনীয় এসব ধান রোপন করা হয়েছিল সেই বর্ষার শেষে। কার্তিকে এসে সবুজ খেত সোনালী হতে শুরু করেছে। বিপরীতে অর্ধবৃত্তের বাঁক নিয়ে স্পিডবোট ঢুকে পড়ল কুকরি মুকরি খালে।

জলধারা এদিকে অতিশয় সরু। খালের উপর ঝুঁকে এসেছে কেওড়া গাছের সারি। কোথাও কোনো নোঙর করা নৌকা থাকলেই গতি কমিয়ে সাবধানে পার হতে হচ্ছে স্পিডবোটকে। ক্রমশ খালটা আরো সরু হয়ে এল। যে কোনো মুহূর্তে পাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা! চালক আল আমিনের দক্ষ হাতে নিরাপদেই সরু খাল পেরিয়ে এল বোট। কিছু সময় পশ্চিমে এগিয়ে পূর্ণ বেগে ছুটল দক্ষিণে।

জলধারা এদিকে প্রশস্ত। পূর্ব পাড়ের বিস্তৃত চরে ধানখেত। তার পেছনে বন। পশ্চিম পাড়ে বনের ওপরে ঝুলে থাকা সূর্যটা দিন শেষের বার্তা দিচ্ছে। লম্বাটে বন সারি পেরিয়েই স্পিডবোট ভেড়ানো হলো জনমানবহীন এক চিলতে সৈকতে।

নারিকেল বাগান সৈকত। ছবি: খন্দকার হাসিবুজ্জামান

কেওড়া বনের পা ছুঁয়ে নরম পলির সৈকত। সামনে বিস্তৃত জলরাশি। সারি সারি জেলে নৌকার ওপাশে আকাশটা ঝুপ করে নেমে গেছে সাগরে। ওখানে, ওই আকাশের দিগন্তে সিঁদুরে রঙ। সাগরের টলোমলো বুকেও মায়াবি সূর্যের মোহনীয় প্রতিফলন। অপার্থিব মায়া আর মোহের আবেশ। প্রতি মুহূর্তেই পাল্টে যাচ্ছে তার রূপ। সারা দিনের কর্মযজ্ঞ শেষে বাড়ির পথে ভাসা জেলে নৌকাগুলো অপরূপ হয়ে উঠেছে আকাশ আর সাগরের সিঁদুরে ক্যানভাসে।

সহসা সাগরের বুকে ঝুপ করে ডুব দিল সূর্যটা। অলস ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পেছনের বনে ছোপ ছোপ আঁধার জমছে। সামনের সাগরে এখনো দিগন্ত পর্যন্ত দৃষ্টি চলে। ওখানে জলের বুকে বিলীন হচ্ছে আকাশের রঙ। এই বুঝি আঁধারে ছেয়ে গেল চরাচর! অগত্যা জনমানবহীন সৈকত ছাড়ল স্পিডবোট। খোলা সাগরকে ডানে রেখে ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে উত্তরে ছুটল মেঘনার উজানে।

পূর্ব দিকে আঁধারে হারিয়ে গেল ঢাল চর। পশ্চিমে বনের কোলে টুকরো টুকরো সৈকত। একটা দুটা  জেলে ঘর। সাগর থেকে সদ্য ফিরে এসে নোঙর ফেলা নৌকা। স্পিডবোট নোঙর ফেলল ডাকাতের খালে। এক সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল বলেই নাকি এ খালের নাম ডাকাতের খাল! এর পূর্ব পাড়ে চর পাতিলা। পশ্চিমে কুকরি মুকরি। এখানে অনেকটা প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের আকার নিয়েছে খালটা। কয়েকটা জেলে নৌকা এসে রাতের জন্য নোঙর ফেলেছে খালের মুখে।

জামালের নৌকায় জেলে আছে মোট ছয় জন। তাদের মধ্যে শাহীনের বয়স মাত্র দশ। সহকারী সে। মাইনে মাসে চার হাজার। সারা দিনে যা মাছ পায় বাকি পাঁচ জন ভাগ করে নেয়। আজ ছয় হালি ইলিশ পেয়েছে জামালের নৌকা। ওগুলোরই এক হালি বায়না করে ফেললেন কুকরি মুকরির স্থানীয় বাসিন্দা আনিচুর রহমান।

চার ইলিশের মিলিত ওজন কেজি তিনেকের কিছু বেশি। সব কটারই পেট ভরা ডিম। এখনো বরফ পড়েনি গায়ে। রফা হলো ১২শ টাকায়। নিজেদের নুন-তেলেই ইলিশ ভেজে দিতে রাজি হলেন জামাল।

কিন্তু নৌকার ভেতর ইলিশ ভাজা হলে আর আনন্দ কোথায়! তাই জেলেদের উনুন ধরে নামানো হলো সৈকতে। খোলা হাওয়ার সঙ্গে লড়ে ধোঁয়া উড়ল। খড়িতে জ¦লল গনগনে আগুন। গরম তেলে ছন ছন শব্দ তুলে ইলিশ ভাজা হতে থাকল কড়াইয়ে। পাশেই খড়ির স্তূপ গড়ে জ্বালানো হলো আগুনের কুণ্ড।

সন্ধ্যারাতে সৈকতে ক্যাম্পফায়ার। ছবি: খন্দকার হাসিবুজ্জামান

হিম হিম সন্ধ্যায় মেঘনার মোহনায় জমে উঠল ক্যাম্প ফায়ার। সেলফোনে বাজল বলিউডি গান। হঠাৎ শিশু হয়ে গেলেন ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশনসের এমডি খন্দকার হাসিবুজ্জামান। শুরু করলেন ধুম-ধাড়াক্কা নাচ। দর্শক হয়ে আসন পাতলেন পরিবার উন্নয়ন সংস্থার পংকজ চন্দ্র দেবনাথ, ইয়ামিন হোসেন, চিত্রগ্রাহক রিয়াজ হোসেন, কেএইচ পাভেল। একে একে এসে জুটতে শুরু করল জেলেরাও। উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠল ডাকাতিয়া খালের পাড়।

ক্যাম্প ফায়ারের আগুন নিভে যেতে ছেদ পড়ল নাচের আসরে। গলা পুড়িয়ে গরম গরম মাছ ভাজি গিলে নিল সবাই। রাত তখন দ্বিতীয় প্রহরে গড়ানোর পথে। আকাশে শুল্কপক্ষের অর্ধেক চাঁদে রাশ পূর্ণিমার আগমনী বার্তা। পেছনের বনে জমাট বেঁধেছে অন্ধকার। সেই বনের ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া সরু খালটাকে আলাদা করে চিনে নেওয়া মুশকিল। তবু অসীম সাহসে ভর করে ওই সরু খালেই গতি তুলল আল আমিনের স্পিডবোট।

সবে জোয়ার আসতে শুরু করেছে। দুপাড়ের ঘন বন ঝুঁকে এসে আঁধার আরো জমিয়ে দিয়েছে খালে। টর্চের আলোয় সামনে খুব বেশি ঠাহর হয় না। সেকেন্ডের ব্যবধানে ধাক্কা খেতে পারে যে কোনো পাড়ে। তবু ওর ভেতরই স্পিডবোটে ৬৫ কিলোমিটার গতি তুলল আল আমিন। আঁধার চিরে এগিয়ে চলল জলের রকেট। দুপাড়ে মাঝেমধ্যে সঙ্গ দিল থোকায় থোকায় জোনাক।

কুকরি মুকরির মূল জনপদেও গাছ আর গাছ। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঘরবাড়ি। বন বিভাগের রেস্ট হাউসটা আলীশান। তিন তলা। পেছনে সুইমিং পুল। কাছেই খালের উভয় পাড় জুড়ে বাজার। জেনারেটর আর সৌর বিদ্যুতে আলোকিত। রাত সাড়ে দশটাতেও চায়ের দোকান খোলা। কাঁচাবাজারে এ চরেই উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া বিকোচ্ছে ৪০ টাকা কেজিতে, ২০ টাকায় পুঁইশাক। তবে শসা, করল্লাসহ অনেক সবজি বাইরে থেকে আনতে হয় এখনো।

জেনারেটর বন্ধ হতেই ঘুমিয়ে পড়ল কুকরি মুকরি। জেগে উঠল পাখি ডাকা ভোরে। প্রধান রাস্তার দুপাশে উঁচু উঁচু গাছ। সারি সারি পুকুর। হাঁস-মুরগির নির্ভয়ে খেলছে রাস্তাজুড়ে।

শাহবাজপুর পার হতেই শুরু হলো গহীন বন। কেওড়া, গেওয়া, পশুর, বেত আর সুন্দরির বিস্তৃত শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ। ভেজা মাটিতে ঊর্দ্ধমুখি শ্বাসমূল সুন্দরবনের আবহ তৈরি করে রেখেছে। মাঝেমধ্যে প্রাণি চলাচলের বুনো ট্রেইল। অসংখ্য চিত্রা হরিণ আছে ১৫ কোটি গাছের বিশাল বিস্তৃত এ বনে। আরো আছে বুনো মহিষ, বানর, বনবিড়াল, উদবিড়াল, শেয়াল, বনমোগরগ, বেজি ইত্যাদি প্রাণি আর গুঁইসাপসহ নানা প্রজাতির সরীসৃপ।

ডাকাতিয়া খালের মোহনা।ছবি: খন্দকার হাসিবুজ্জামান

দেখতে দেখতে ট্রেইলটা শেষ হয়ে এল। ডাকাতের খাল পেরিয়ে এবার নারিকেল বাগান সৈকতে।

বনের ভেতর একটা ওয়াচ টাওয়ার। তার সামনে বিস্তৃত ঘাসের মাঠ। মাঝেমধ্যে মাথা তুলছে শ্বাসমূল। সামনে মেঘনা। মাঝ নদীতে সকালের সূর্যটা কুয়াশার সঙ্গে যুঝছে।

নদীর মোহনা হলেও এ পাড়টা সৈকত হিসেবেই পরিচিত। ছাড়া ছাড়া ঘাঁসের ফাঁকে ফাঁকে লাল কাঁকড়ার গর্ত। প্রাতরাশের খোঁজে জলের কিনারায় ওঁত পেতে বসে এক ঝাঁক বক। শঙ্খচিল, মথুরা, বন মোরগ, কাঠময়ূর, কোয়েলসহ হরেক প্রজাতির দেশি আর অতিথি পাখির মিলনমেলা বসে এখানে। নদীর বুকে বছরভরই ইলিশ শিকার করে জেলেরা।

এক যুগ আগে সিডরে উপড়ে যাওয়া গাছগুলো এখনো শিকড় মেলে পড়ে আছে বনের কিনারে। পড়ে যাওয়া গাছেও প্রাণের কোরাস। ডালের ভাঁজে আয়েসে বসার অদ্ভূত আসন। মাথার ওপরে ডালপাতার ছাউনি। এখানকার নারিকেল আর কেয়া ঝোপ সেন্টমার্টিনসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কক্সবাজার আর কুয়াকাটা সৈকতের সঙ্গেও কোথায় যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে কুকরি মুকরি সৈকতের। প্রকৃতিতে মিশে যাওয়ার মোক্ষম স্থানই বটে!

বালুকাবেলায় মরে পড়ে থাকা অতিকায় এক গুঁইসাপ কেবল বেদনা ছড়াচ্ছে মেঘনার মোহনায়। বন দোলানো হু হু বাতাসে যেন তারই চাপা কান্না! অবিবেচক মানুষের বিবেক হয়ে রোদে পুড়ছে নীরবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *