সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / হাওরাঞ্চল / কিশোরগঞ্জ / বিপ্লবী থেকে লেখক

বিপ্লবী থেকে লেখক

ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সংগঠক, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। এসবের বাইরেও তার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় রয়েছে, তা হলো তিনি একজন লেখক। তার রচিত ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থটিই মানুষের মাঝে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর লেখক পরিচয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ৫০ বছর আগে প্রকাশিত বইটি আজো মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। তার এ আত্মজীবনীমূলক বইটি পড়ে পাঠক একই সাথে লেখক ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ও বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে জানতে পারেন। বইটি সম্পর্কে ভারতের বিখ্যাত বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৯৬৯ সালের ১৯ মে ছাপা হওয়া এক আলোচনায় বলা হয়, “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস কবে রচিত হবে জানি না, তবে সে ইতিহাস যদি কোনদিন রচিত হয়, তাহলে সে ইতিহাসের সংকলনের একখানি অতি মূল্যবান গ্রন্থ নিঃসন্দেহে তাঁর গ্রন্থনায় সাহায্য করবে। সে গ্রন্থটি হল ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ‘জেলে ত্রিশ বছর’। এই নাতিদীর্ঘ ও বহু আদৃত গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।”

বর্তমানে গ্রন্থটি বাংলাদেশ ও ভারতে দুটি ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে বইটির নাম ‘জেলে ত্রিশ বছর—ব্রিটিশ: পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস’, প্রকাশক ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা। আর ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নামে। প্রকাশক র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা।

এ বইয়ের বাইরে তার আরো দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। যার একটি হলো ‘গীতার স্বরাজ’, অন্যটি ‘জীবনস্মৃতি’। কিন্তু এখন আর এ বই দুটির সন্ধান পাওয়া যায় না। ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে ‘গীতার স্বরাজ’ নামের বইটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তবে সেখানে বইটির নাম ‘গীতার স্বরাজ’, এমনটির উল্লেখ নেই। তিনি লিখেছেন, “এই সময় আমি গীতার ভাষ্য লিখিতে আরম্ভ করিলাম। জেলে আমি স্বামী কৃষ্ণানন্দ, তিলক মহারাজ, বঙ্কিমবাবু এবং আরো অনেকের গীতার অনুবাদ পাঠ করিয়াছি। তাঁহারা গীতাভাষ্যে পাণ্ডিত্য দেখাইয়াছেন খুব, কিন্তু আমার পছন্দ হয় নাই। আমি গীতার শঙ্করভাষ্যও দেখিয়াছি। আমার মনে হইল, আমিও আমার মনোমত গীতার ভাষ্য লিখিব, আমি গীতার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা করিলাম। গীতা আমাদের দেশে সকলেই পড়েন, এমনকি গীতা পাঠ না করিলে হিন্দুর শ্রাদ্ধ কার্য সমাপ্ত হয় না। আমার মতে গীতার প্রকৃত অর্থ বুঝিতে হইলে প্রথমত দেখিতে হইবে, কোন সময় গীতার সৃষ্টি হইয়াছে এবং শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ শুনিয়া অর্জুন কী করিলেন।… আলিপুর জেলে আমি গীতার চারিটি অধ্যায়ের ব্যাখ্যা করি। আমি গীতার শ্লোকে সাধারণ ব্যাখ্যা লিখিয়া ‘ভাবার্থে’ আমার মত গীতার মধ্য দিয়া, অর্থাৎ ‘শ্রীকৃষ্ণের এই শ্লোক বলার এই অভিপ্রায় ছিল’ এইভাবে চালাইয়া দিয়াছি। ১৯২৪ সনে মুক্ত হইবার পর আমি মাত্র অল্প কয়েক মাস বাহিরে ছিলাম। কাজেই এই দিকে মন দিতে পারি নাই।” [জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১০৩-৪]

মহারাজত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ১৯২৪ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হয়ে প্রায় চার বছর জেল খেটে ছাড়া পান ১৯২৮ সালে।

তিনিবলছেন, ‘১৯২৮ সনে মুক্ত হইয়া বাহিরে আসিয়া আমার লিখিত গীতাভাষ্যের খাতাখানা পাইয়াছিলাম এবং এই দিকে পুনরায় মন দিলাম। ১৯২৮ সনে মুক্ত হইবার পর গীতার প্রথম খণ্ড আমি চারি অধ্যায়ে প্রকাশ করি।’ [জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১১৮]

সে সময়ের বিখ্যাত দুটি পত্রিকা প্রবাসী ও আনন্দবাজারে বইটির আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি নিয়ে পাঠকমহলে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বেশ। বইটি ছাপানো বাবদ যে পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়েছিল, তার সবটাই বিক্রি করে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন লেখক।

তিনি নিজেই বলছেন, ‘গীতা ছাপাইয়া আমি অর্থিক লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হই নাই, ছাপার খরচ আমার উঠিয়া গিয়াছিল।’ [পৃষ্ঠা ১১৮]

১৯৩০ সালের এপ্রিলে রাজশাহীতে গ্রেফতার হয়ে মহারাজ তখন পঞ্চমবারের মতো জেল খাটছেন। তখন তাকে রাজশাহী জেল থেকে বহরমপুর জেলে, তারপর পাহাড়ের ওপর স্থাপিত ‘বক্সা ক্যাম্প’ জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি গীতার বাকি অধ্যায়গুলোর ব্যাখ্যা লেখেন। এর প্রায় আট বছর পর ১৯৩৮ সালে জেল থেকে মুক্ত হন মহারাজ। তখন দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আর গীতাভাষ্য প্রকাশে আগ্রহী হলেন না। তখন তার মনে হলো, এখন এত বড় বই বেশি বিক্রি হবে না, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাছাড়া বই প্রকাশ করার মতো এত টাকাও মহারাজের হাতে ছিল না।

মহারাজ বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, কারাগারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কারাবিধিতে ছিল এমন কোনো শাস্তি বাদ নেই, যা মহারাজ ভোগ করেননি। ১৯১৪ সালের দিকে সেবার তৃতীয়বারের মাতো আটক হলেন বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বরিশাল জেল থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে বদলি হলেন। হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি, কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় চালান দেয়া হলো। প্রেসিডেন্সি জেলে পৌঁছার পর তাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হলো এবং ৪৪ ডিগ্রিতে বন্ধ করল। ক্ষুদ্র একটি সেলের মধ্যে দিন-রাত সময় কাটাতে হতো তখন। কারো সাথে কথা বলা যেত না। কারো সাথে কথা হয়েছে, এটি প্রমাণিত হলে শাস্তির পরিমাণ আরো বেড়ে যেত। পাথরসমেত নিম্নমানের চালের ভাত পরিবেশন করা হতো নিত্যদিন। তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কবিতা লিখলেন—

‘জেলের বেটা বড় খচ্চর

খেতে দেয় ধান আর পাথর…।’

জেলখানায় প্রচণ্ড শীতে চাহিদা অনুযায়ী কম্বল না পেয়ে আবার লিখলেন—

‘সুপারিন্টেন্ডেন্ট বড় পাঁজির পাঁজি,

বেশি বেশি কম্বল দিতে হয় না রাজি।’

জেলে কাগজ-কলম না থাকায় প্রতিবাদী এ কবিতাগুলো কোনো কাগজে লিখে রাখতে পারেননি, মুখস্থ করে রাখতে হয়েছে। কবিতাগুলো তিনি জেলের মধ্যে চিত্কার করে অন্যদের শোনাতেন। অন্যরাও নিজেদের লেখা কবিতা শোনাতেন মহারাজকে।

জেলখানায় বসে তার সহযোদ্ধা বন্দি প্রতুল বাবু লিখলেন ‘যদি মহারাজ না আসিত’ শিরোনামে একটি কবিতা। প্রতুল বাবু তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুকরণ করে কবিতা লিখতেন।

এই জেলে বেশ কিছুদিন থাকার পর ১৯১৬ সালের মধ্যভাগে মহারাজকে আন্দামান জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সাধারণ কয়েদিসহ তার সঙ্গে আরো ৯৬ জন ছিলেন। এর মধ্যে নারী-শিশুও ছিল। মহারাজকে সে সময় আন্দামান পাঠানোর কথা ছিল না। কারণ তিনি হাঁপানি রোগী ছিলেন। আন্দামানে সাধারণত রোগীদের পাঠানো হতো না। আন্দামানে জেল খাটা মানে দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করা, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। একবার গেলে সেখান থেকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা খুব কঠিন কাজ ছিল। মহারাজকে যখন আন্দামান পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তখন নির্জন জেলে বসে তার কত কিছুই মনে হচ্ছিল, কিন্তু কোনো কিছুই কারো কাছে ব্যক্ত করার সুযোগ ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছেন, আর হয়তো কখনো ফিরবেন না বাংলার মাটিতে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কারো সাথে দেখা হলো না। কাউকে কিছু বলার সুযোগ পেলেন না, কারো কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সুযোগও তার হলো না। এই অবস্থায়ই অনিশ্চিত জেলজীবনের আন্দামান যাত্রার প্রস্তুতি চলছে। হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি, কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় মহারাজসহ অন্যদের জেল অফিসের সামনে আনা হলো। তারা জোড়া করে বসলেন। এমন সময় জেলার সাহেব পরিদর্শনে এলেন। আর মহারাজকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তুমি সেখানেই মরিবে।’ এর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সেলের ভেতর দেয়ালে সুড়কি দিয়ে লিখলেন—

‘বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে,

এই প্রার্থনা করি মাগো মনে যেন রেখো সন্তানে।

আবার আসিবো ভারত-জননী মাতিব সেবায়,

তোমার বন্ধন মোচনে মাগো যেন এ প্রাণ যায়।

বিদায় ভারতবাসী, বিদায় বন্ধু, বান্ধবগণ,

বিদায় পুষ্প তরুলতা, বিদাq পশু, পাখিগণ।

ক্ষমো সবে যত করেছি অপরাধ জ্ঞানে অজ্ঞানে,

বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে।’

এ কবিতার মধ্য দিয়ে একজন মহান বিপ্লবীর মনের গভীরের দুঃখ-বেদনা আর যন্ত্রণার কথা উঠে আসে, গভীর দেশপ্রেমের কথা উঠে আসে।

গ্রন্থ রচনার বাইরেও তিনি বিভিন্ন সময় নানাবিধ বিষয়ের ওপর লিখেছেন, যেমন লিখেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য, তেমনি লিখেছেন কারাগারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে। মাদ্রাজের জেলে থাকার সময় মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী কারা সংস্কার সম্পর্কে লিখতে আরম্ভ করেন। ততদিনে তার প্রায় ২৪ বছর জেল খাটার অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। তিনি মাদ্রাজ, বাংলা অঞ্চল, ব্রহ্মদেশের বিভিন্ন জেলে ছিলেন, ছিলেন আন্দামানেও।

এসব জেলে থাকার সময় ভারতের বিভিন্ন জেলে থাকা বন্দিদের সাথে তার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়েছে। জেলে বহু বছর তিনি সাধারণ কয়েদির মতো ছিলেন, ছিলেন স্পেশাল ক্লাসের কয়েদিও। জেলজীবনে জেল কোডের মধ্যে যত ধরনের সাজা আছে, সব ধরনের সাজাই তিনি ভোগ করেছেন, কিংবা ভোগ করতে বাধ্য হয়েছেন। জেলার থেকে শুরু করে সাধারণ কয়েদি সবার সঙ্গেই মেশার সুযোগ হয়েছে তার। সে সময় প্রায় আড়াই দশক কারাবন্দি জীবন কাটিয়ে জেল সম্বন্ধে তার বিস্তর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমন সময় এসে তিনি কারাগারের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করলেন। জেলে কীভাবে কী হয় সবকিছুই তিনি জানতেন নিখুঁতভাবে। একসময় মনে হলো, তার জেলজীবনের অভিজ্ঞতা লিখে রাখা উচিত। লিখে রাখলে সেটি কাজে লাগতে পারে। সেই চিন্তা থেকে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী লেখা শুরু করলেন।

তিনি বলছেন, ‘প্রথমত আমি জেলের উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে লিখিলাম। তারপর লোকে অপরাধ করে কেন, জেলের সাধারণ অবস্থা, জেল কর্মচারীরা কীভাবে চুরি করে, কয়েদিদের প্রতি কী জন্য, কীভাবে নির্যাতন হয়, গভর্নমেন্ট কীরূপে সংবাদ পান, জেলে যুবক, বালক, মেয়ে কয়েদিদের অবস্থা কীরূপ এবং আমার মন্তব্যে কীভাবে কারাসংস্কার হইতে পারে, তাহা লিখিলাম। আমি কোনো ব্যক্তিবিশেষের নামে, বিশেষ কোনো জেলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করি নাই, কাহারও নামে কিছু বলিও নাই, কেবল সাধারণভাবে জেলের অবস্থা বর্ণনা করিয়াছি।’ [জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৩১]

মহারাজ তার মুক্তির কিছুদিন পর ১৯৩৯ সালে লেখার খাতাটি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য রামানন্দ বাবুকে দিয়েছিলেন। তিনি লেখাগুলো প্রবাসীতে প্রকাশ করতে সম্মত হয়েছিলেন। সেমতে লেখাগুলো অধ্যায় অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে দিতে বলেছিলেন মহারাজকে। মহারাজ তাতে সম্মত না হওয়ায় তিনি নিজেই ঠিকঠাক করে প্রকাশ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। এর কয়েক মাস পর মহারাজ আবার গ্রেফতার হলে কারাগারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও নিজের অভিজ্ঞতাসংক্রান্ত লেখার কী হলো তার আর খোঁজ নিতে পারেননি। তিনি জেলে থাকতেই ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

আলীপুর জেলে থাকার সময় শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রনাথ শাসমল একবার মহারাজকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক লেখার জন্য বলেন। মহারাজ তার উপদেশ শুনে লেখা শুরু করেন। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল মাঝে মাঝে মহারাজের তৈরি করা পাণ্ডুলিপি দেখতেন এবং কিছু জায়গায় পরিবর্তনের পরামর্শ দিতেন। মহারাজ সে অনুযায়ী পাণ্ডুলিপিতে সংশোধন আনতেন। তিনি যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বই রচনা করছেন, এ সংবাদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে পৌঁছে জমিদার হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মাধ্যমে। পরে দেশবন্ধু মহারাজের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান এবং পাণ্ডুলিপি দেখতে চাইলে মহারাজ তাকে পাণ্ডুলিপি দেখতে দেন। প্রাইমারি এডুকেশন স্কিমে কাজে লাগবে বলে জেল থেকে বের হওয়ার সময় দেশবন্ধু মহারাজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে যান। তবে এর একটি অনুলিপি মহারাজ তার নিজের কাছে রেখে দেন। বিষয়টি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুও জানতেন বলে মহারাজ তার বইতে উল্লেখও করেছেন।

এ লেখালেখি নিয়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে কম যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। অর্জন করেছেন তিক্ত অভিজ্ঞতাও। রাগ হয়ে একবার তিনি জেলখানায় থাকার সময় লেখা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বইয়ের পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলেন।

তিনি তার বইতে লিখেছেন, ‘১৯২৯ সনে আমি একদিন সুভাষ বাবুকে বলিয়াছিলাম আমার আলিপুর জেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য লিখিত খাতাগুলি পাইয়াছি, এখন যদি সেগুলি কলিকাতা কর্পোরেশন স্কুলে পাঠ্য করিবার ব্যবস্থা করিয়া দেন তবে আমার কিছু আর্থিক সুবিধা হয়। বাড়ি ছাড়ার পর হইতে আমার খরচ চিরকালই আমার বন্ধুবান্ধবরা চালাইয়া আসিয়াছেন। বাড়ির সঙ্গে আমার বিশেষ কোন সংস্রব ছিল না। কলিকাতার বহুবাজার স্ট্রিটে একটা ম্যাচ ছিল। শ্রীমান কেদারেশ্বর সেন সেখানে একটা সম্পূর্ণ কোটা ভাড়া করিয়া থাকিত। আমি তখন কেদারের নিকটই থাকিতাম। আমার খাওয়া খরচ কেদারই চালাইত। আমার প্রস্তাব শুনিয়া সুভাষ বাবু কর্পোরেশনের এডুকেশন অফিসার ক্ষিতীশ প্রসাদের [k.p. chatterjee] নিকট একখানা ভালো সুপারিশপত্র লিখিয়া দিয়া আমাকে তাহার বাসায় যাইয়া দেখা করিতে বলিলেন।

আমি পরদিন সুভাষ বাবুর চিঠি ও খাতাগুলি লইয়া এডুকেশন অফিসারের তখনকার বাসার যাইয়া তাহার সহিত দেখা করিলাম। তিনি খাতাগুলি দেখিতে চাহিলেন। আমি খাতাগুলি তাহাকে দিলাম। তিনি আর একদিন আসিয়া দেখা করিতে বলিলেন, আমি সন্তুষ্ট হইয়া চলিয়া আসিলাম। ইহার পর আমি প্রায়ই তাহার বাসায় যাই, দুই-তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি নিচে নামিয়া আসেন এবং আর একদিন আসিতে বলেন। একদিন তিনি বলিলেন, এক লেখকের এতগুলো বই পাঠ্য তালিকাভুক্ত করিতে পারিব না, আমাদের কমিটি রাজি হইবে না এবং অন্যান্য গ্রন্থাকারগণ হৈচৈ করিবে, আমি দুই-একখানা বই পাঠ্য তালিকাভুক্ত করিয়া দিব। আমি ইহাতেই সন্তুষ্ট হইলাম। তিনি দুই-একখানা বইয়ের দুই-এক জায়গায় কিছু পরিবর্তন করিয়া দিতে বলিলেন, আমি তাহাই করিয়া দিলাম। ইহার পরও আমি তাহার বাসায় যাই এবং বহুক্ষণ অপেক্ষার পর ফিরিয়া আসি ও মনে মনে চটি।

আমি জানিতাম, গ্রন্থাকারদের বই পাঠ্য তালিকাভুক্ত করিতে বহু বেগ পাইতে হয়, বহু মাল-মসলা খরচ করিতে হয়, তৈল মর্দ্দনও করিতে হয় বহু এবং কয়েক জোড়া জুতার তলিও বদলাইতে হয়। কিন্তু আমার ধাত অন্যরকমের, দীর্ঘকাল ইহা পোষাইল না। আমার মনে হইল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মহাশয়ের সহিত দেখা করিতে আমার কোনো বেগ পাইতে হয় নাই। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষ বাবুর সহিত দেখা করিতে এতক্ষণ বসিয়া থাকিতে হয় না, আর একজন এডুকেশন অফিসারের সহিত দেখা করিবার জন্য এতক্ষণ বসিয়া থাকা অত্যন্ত অসহ্য ও অপমানকর।

একদিন প্রাতে সাতটা হইতে দশটা পর্যন্ত বসিয়া আছি, তিনি উপর হইতে বলিয়া পাঠাইলেন তাহার অফিসে যাইয়া দেখা করিতে। আমি পূর্বেই সংবাদ লইয়াছিলাম যে তিনি কোনো কাজ করিতেছিলেন না। আমি তাহার উপর চটিয়া গেলাম এবং এক টুকরো কাগজে শুধু ইহা লিখিয়া পাঠাইলাম, আমি বহু বাজার স্ট্রিট হইতে হাঁটিয়া এতদূর রাস্তা আসিতে পারিলাম, আর আপনি উপর হইতে নিচে নামিয়া আসিতে পারিলেন না, তিন ঘণ্টা আমাকে বসাইয়া রাখিলেন? ইহা বড়ই দুঃখের বিষয়।

তিনি আমার ওপর ভীষণ চটিয়া গেলেন এবং বীরদর্পে নিচে নামিয়া আসিয়া বলিলেন, কিছু হবেটবে না ও কিছু হয় নাই, আপনি চলিয়া যান।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আমার খাতা ফেরত পাইব কি? তিনি বলিলেন, আমার অফিস হইতে নেওয়াইয়া লইবেন।

আমি কর্পোরেশনের একজন শিক্ষককে (অমূল্য অধিকারী) পাঠাইয়া আমার খাতাগুলি ফেরত আনাইলাম। অফিসে ধমক খাইলে কেরানি বাবুদের যেমন গিন্নির উপর রাগ হয়, আমারও তেমনি রাগ হইল খাতাগুলির উপর। আমি এই কথাগুলি নষ্ট করিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম, এখন আর কাহারও অনুগ্রহপ্রার্থী হইতে হইবে না। ইহার কিছুদিন পর সুভাষ বাবুকে এই ঘটনা জানাইয়াছিলাম। তিনি শুনিয়া খুব দুঃখিত হইয়াছিলেন।’ [জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১১৮-১৯]

লেখক: ফয়সাল আহমেদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *