সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / হাওরাঞ্চল / কিশোরগঞ্জ / মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিন লাখ মুসুল্লির নামাজ আদায়

মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিন লাখ মুসুল্লির নামাজ আদায়

নিজস্ব সংবাদদাতা : মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে উৎসবমুখর পরিবেশ ও কড়া নিরাপত্তায় আজ মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া মাঠে অনুষ্ঠিত হলো দেশের অন্যতম বৃহৎ ঈদের নামাজ। এই নামাজে অন্তত চার লক্ষাধিক মুসল্লি অংশ নেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। করোনা পরিস্থিতির কারণে দু’বছর বন্ধ থাকার পর অনুষ্ঠিত জামাতে তাই মুসল্লিদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। ছিল চোখে পড়ার মতো বাড়তি উচ্ছ্বাস-আনন্দও।

কিন্তু নামাজের আগে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে মুসল্লিদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এটি ছিল শোলাকিয়ায় ঈদুল ফিতরের ১৯৫তম জামাত। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া ঈদের নামাজে ইমামতি করেন বড়বাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা হাফেজ মো. শোয়াইব বিন আব্দুর রউফ। নামাজ শেষে বিশ্বশান্তি, দেশ ও মুসলিম উম্মাহর সমৃদ্ধি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।

ঈদের জামাতকে ঘিরে নজিরবিহীন কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় শোলাকিয়া ও আশাপাশের এলাকা। চার স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হয় ঈদগাহ মাঠে। তার পরও সকাল ৯টার আগেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় শোলাকিয়া। এসময় বৃষ্টিপাত শুরু হলে মুসল্লিরা প্লাস্টিকের কাগজ মাথায় দিয়ে শোলাকিয়ায় অবস্থান নেয়। অনেকে কাকভেজা হয়েও নামাজে অংশ নেয়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও চার লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম।

দেশের সবচেয়ে বড় এ জামাতে অংশগ্রহণ করতে ভোর থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই মুসল্লিদের ঢল নামে জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরের এ ঈদগাহ মাঠে। ঈদগাহমুখী সব রাস্তাঘাট মুসল্লিদের দখলে চলে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য এসব সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। জামাত শুরুর প্রায় দুই ঘণ্টা আগেই সাত একর আয়তনের শোলাকিয়া মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববতী রাস্তা, তিনপাশের ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড় ও বাড়ির ছাদে জায়গা করে নিয়ে জামাতে শরিক হন।

নামাজ শুরুর আগে মুসল্লিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম, পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ ও পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ।

২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি সর্তকর্তার অংশ হিসেবে শোলাকিয়ায় নেয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা। নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয় পুরো আয়োজন। পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব, আনসার সদস্যের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের পাশাপাশি মাঠে সাদা পোশাকে নজরদারি করেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। আরো নজরদারিতে ছিল পুলিশের ড্রোন ক্যামেরা। এছাড়া মাঠ ও শহরসহ প্রবেশ পথগুলো সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাঠে স্থাপিত ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরবীন নিয়ে নিরপত্তার দায়িত্ব পালন করে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। শোলাকিয়া মাঠ ও শহরের যত অলিগলি আছে, সবখানে বসানো হয় নিরাপত্তা চৌকি। ঈদগাহ এলাকায় মেডিক্যাল টিম এবং অগ্নি-নির্বাপন দলও মোতায়েন ছিল। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিল বিপুল সংখ্যক স্কাউট সদস্য। প্রত্যেক মুসল্লিকে মেটালডিটেক্টর দিয়ে দেহ তল্লাশি করে তারপর মাঠে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়।

শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম, পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ, জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজসহ জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ আদায় করেন।

গত ২৫ বছর ধরে এ মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করছেন ময়মনসিংহের নান্দাইলের আবুল কাশেম (৬০)। কিন্তু গত দুটি বছর করোনার কারণে শোলাকিয়ায় নামাজ হয়নি। তাই গত দুটি ঈদে এখানে আসা হয়নি তার। এজন্য মনে খুব কষ্ট ছিল। তবে এবার আবার নামাজ আয়োজন হয়েছে। ইচ্ছে ছিল শোলাকিয়ার নামাজে আসবেন। আজ সেই আশা পূরণ হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজলেও এতে তার মনে কোনো আক্ষেপ নেই বলে জানান।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের টান সিদলা গ্রামের তোরাব আলী (৫৫) সাইকেল চালিয়ে এসেছেন শোলাকিয়ায়। তিনি বহুবার এই মাঠে নামাজ আদায় করেছেন। এখানে নামাজ আদায় করে মনে শান্তি পান তিনি। তাই বার বার ছুটে আসেন।

শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, করোনার কারণে দু’বছর শোলাকিয়ায় নামাজ হয়নি। এ জন্য মানুষের মনে এই নামাজ নিয়ে আক্ষেপ ছিল। এইসব কারণে এবার নামাজে মুসল্লিদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। নামাজের সময় মুষলধারে বৃষ্টি হলেও লোকজন ধৈর্য ধরে নামাজ আদায় করেছে, যা ছিল দেখার মতো ঘটনা।

মাঠের সুনাম ও নানা জনশ্রুতির কারণে ঈদের কয়েক দিন আগেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারাদেশের বিভিন্ন জেল থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এদের অনেকেই উঠেছিলেন হোটেলে, কেউবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ও শোলাকিয়া ঈদগাহ মিম্বরে।

ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে দুটি বিশেষ ট্রেন চলাচল করা হয়। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। অন্যটি ময়মনসিংহ থেকে সকাল পৌনে ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। দেশের বৃহত্তম এ ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে মাঠ পার্শ্ববর্তী এলাকায় হস্ত, কারু ও নানারকম শিল্পের মেলা মুসুল্লিদের জন্য ছিল অন্যতম আকর্ষণের বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *