সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / বাংলাদেশ / জাতীয় / জীবন কাটে অনিশ্চয়তায়

জীবন কাটে অনিশ্চয়তায়

জাকারিয়া মন্ডল : বিরুলিয়া বাজারে অলস সময় কাটছে গয়ানাথ রাজবংশীর। যদিও রোদে পোড়া তামাটে শরীর। তবে উদয়াস্ত খাটুরে হওয়ায় চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। তার বয়স যে ৬০ তা বলে না দিলে বুঝে নেয় সাধ্যি কার! কিন্তু, অনিশ্চিত জীবিকার কারণে উদ্বেগের ছাপ ঠিকই ফুটে আছে চোখের কোনায়।

সেই শৈশব থেকেই তুরাগ নদের সঙ্গে জীবন বাঁধা গয়ানাথের। নদীর পাড়েই তাদের মাঝিপাড়া। শৈশব কেটেছে তুরাগের পানিতে সাঁতার কেটে। বাবা-কাকাদের হাত ধরে এই তুরাগেই জীবিকার হাতেখড়ি সেই শৈশবেই। কৌতূহলী কৈশোরে সব কৌতূহল ছিলো তুরাগকে ঘিরেই। তারপর যৌবন ও পৌড়ত্ব পেরিয়ে এখন বার্ধক্যের দিকে ধাবিত। তার চোখের সামনেই একটু একটু করে বুড়িয়ে গেছে তুরাগও।

ফি বছর কার্তিক-অগ্রহায়ণ এলেই এখন খারাপ হতে থাকে তুরাগের পানি। স্বচ্ছ পানি একটু একটু করে কালো হতে থাকে। তারপর হয়ে পড়ে দূষিত। ছড়ায় দুর্গন্ধ। এ বছরও তাই হয়েছে। ঘাটপাড়ের বাজার, এমনকি জেলে পাড়াতেও এসে নদীজীবীদের নাকে ধাক্কা দেয় তুরাগে পঁচে যাওয়া পানির দুর্গন্ধ।

সুদে ঋণ নিয়ে নৌকা ও জাল কিনেছিলেন গয়ানাথ। সেই জাল এখন তুলে রাখা ঘরের মাচায়। ডাঙ্গায় তুলে রাখলে নষ্ট হবে বলে নদীতেই খুঁটি গেড়ে নৌকাটা এখনও বেঁধে রাখা। সূর্যটা এরই মধ্যে দিনের দ্বিতীয় প্রহরের ঘরে গনগন করতে শুরু করেছে। আজ বোধ আর কেউ কামলা নেবে না তাকে। ২/৩শ টাকা রোজে কামলা খাটার কাজটাও তার নিজের হাতে নেই। কেউ এলে ডাক পড়ে, নয়তো বেকারই থাকেন। ভাগ্য ভালো হলে জোটে দূরবর্তী কোনো ঘের বা পুকুরে ভাড়ায় মাছ ধরতে যাওয়ার ডাক। সেটাও কালেভদ্রে। গয়ানাথ তাই এই মৌসুমটাতে প্রায়ই বেকার থাকেন। ঘাটপাড়ে বসে তাকিয়ে থাকেন দূষিত নদীর দিকে। ফের বর্ষা এলে তবেই পরিষ্কার হবে পানি। তাতে মাছ খেলবে। গয়ানাথ তার সঙ্গীদের নিয়ে ফের মাছ ধরবেন। পরিবারের অন্ন যোগাবেন। একটু একটু করে শোধ করবেন মহাজনের ঋণ। ফের ঋণ নেওয়ার আগে যতোটা কমানো যায় ততোটাই স্বস্তি ফেরে মনে। কিন্তু, জীবনচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া ঋণের চক্র কখনোই পুরোপুরি কেটে যায় না জীবন থেকে।

নদীর পাড়ে বাঁধা নৌকায় বসে স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যান গয়ানাথ। তার যখন যৌবন, এই নদীরও যৌবন ছিলো তখন। বারোমাসই বইতো পরিষ্কার পানি। সেই পানিতেই নাওয়া। সেই পানিতেই ঘর-গৃহস্থালি, রান্না-খাওয়া। কতো প্রজাতির যে মাছ ছিলো এই তুরাগে, গুণেও শেষ করা যেতো না। ফেলতেন বেড় জাল। ৬০/৭০ হাত লম্বা। জাল ভর্তি মাছ উঠতো। জীবনের সব খুশি যেনো ওই জালের ভেতরই ভেসে উঠতো তখন। বছরভর মাছ খেতে পারতেন নিজেরা। মাছ বিক্রি করেই সুন্দর চলে যেতো সংসার।

কিন্তু সেসবই এখন অতীত। আগে যে মাছ একদিনে পাওয়া যেতো, এখন সারা বছরেও পাওয়া যায় না। তবুও বর্ষার আসায় বসে থাকেন গয়ানাথরা। পানি ভালো হলে মাছ আসতে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়ে শ্রাবণ-ভাদ্রে। পানি যতো ভালো হয়, মাছও হয় ততো বেশি। তবে আগের মতো অতো প্রজাতির মাছ আর মেলে না এখন। গতমৌসুমে সর্বোচ্চ হাজার পাঁচেক টাকার মাছ ধরেছেন দিনে। ওগুলোর ভেতর নলা, মলা, রুই, কাতল, চান্দা আর গুড়াগাড়াই বেশি। কম হলেও বোয়াল ও চিতল মিলেছে কিছু। কিন্তু বাটোয়ারার পর কতোটুকুইবা আর মাছ মিলেছে নিজের ভাগে!

এক সঙ্গে পাঁচ/ছয় জন মিলে মাছ ধরেন। দিন শেষে সবার ভেতর হয় সমান ভাগ। এই বাটোয়ারায় অবশ্য নৌকা ও জালকে একজন জেলের সমান ধরা হয়। তাই ছয় জন মিলে মাছ ধরলে ভাগ হয় সাতটা। এতে সারা দিনে পাঁচ হাজার টাকার মাছ ধরতে পারলে প্রতি জনের ভাগে সাতশ ১৪ টাকার মতো পড়ে। গয়ানাথের যেহেতু নিজের নৌকা ও জাল। তাই দুই ভাগ জোটে তার। তার মানে সাকুল্যে ১৪শ ২৮ টাকার মতো। তার ভেতর সংসার খরচ তো আছেই। বাড়তি চাপ হয়ে আছে মহাজনের ঋণ শোধের তাগিদ।

নদীতে ধরা মাছ নদী পাড়েরই বিরুলিয়া বাজার, কাছের বাসট্যান্ড ও আড়তে বিক্রি করতেন আগে। এখনও স্থানীয় বাজারেই বিক্রি করেন বেশি। তাতে দাম মেলে কম। উপরন্তু, যে বাজার একসময় তুরাগের মাছে ভরপুর ছিলো, সেখানে এখন বিক্রি হয় বাইরে থেকে আনা চাষের মাছ। ওগুলোর দাম কম বলে নদীর মাছও বেশী দামে বিক্রি করতে সমস্যা হয়।

এতোসব সমস্যার পরও জেলেজীবনের পাঁকেই বাধা পড়ে থাকেন গয়ানাথরা। কোনোরকমে নাম লিখতে পারলেও পড়ালেখাটা শেখা হয়নি তার। অন্য কোনো কাজ শেখেননি বলে পেশাবদলও করতে পারেন না। সরকারের পক্ষ থেকে অমৌসুমে মৎস্যজীবীদের সহায়তার জন্য যে কার্ড দেওয়া হয়েছে তাও জোটেনি গয়ানাথের কপালে। দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। টাকার অভাবে হয়তো সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধই করে দিতে হবে তাকে। দিনের ঝলমলে আলোতে বসেও গয়ানাথের জীবনে নেমে আসা ঘোর অমানিশার অন্ধকার স্পষ্টতই টের পাওয়া যায়।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও ফেলো, রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *