সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / বাংলাদেশ / জাতীয় / প্রতিটি শিশু হোক সেই খোকা

প্রতিটি শিশু হোক সেই খোকা

জাকারিয়া মণ্ডল : কৌতূহলী শৈশব-কৈশোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ভীষণ ডানপিটে। খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াতেন, খেলতেন ফুটবল, ভলিবল, হকি। ইচ্ছে হলে গান গাইতেন, মন চাইলে হিজলের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তেন পানিতে। তাঁর কোনো দস্যিপনাতেই বাধা ছিল না বাবা-মায়ের। মাতা-পিতা খুবই স্নেহ করতেন তাঁকে। ছোট্ট মুজিবকে তারা ডাকতেন খোকা নামে।
পরিণত বয়সেও মা-বাবার খোকাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ দুটিতে তার এ বিষয়ক স্মৃতিচারণ মন ছুঁয়ে যায়।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর লেখনী বলছে, শৈশবকালেও তাদের বাড়িতে ছিল মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের তৈরি চার চারটে ভগ্নপ্রায় দালান। এক দালানে থাকতেন বঙ্গবন্ধুর এক চাচা। ভঙ্গপ্রায় আরেক দালানে এক মামা। ভেঙে পড়া আরেক দালানে ছিল বিষাক্ত সাপের বাস। ওসব দেখেই বড় হতে থাকেন বঙ্গবন্ধু।
পারিবারিক দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনে উচ্চতর পড়াশোনার আশা ছেড়ে দেওয়ানি আদালতে চাকরি নেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান। নিজের জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়া ছেড়ে তখন গোপালগঞ্জ শহরে থাকতে হতো তাকে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ছোট দাদা শেখ আবদুর রশিদ একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এলাকায়। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ওই স্কুলেই অধ্যয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। পরে পিতার কাছে চলে যান। গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণিতে। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তার গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসত না। আমি বংশের বড় ছেলে, তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।’
সময়ের নিয়মেই শৈশবের পর কৈশোর কাটে, যৌবন পেরিয়ে পৌঢ়ত্বের দিকে ধাবিত হয় জীবন। কিন্তু মা-বাবার কাছে খোকা হয়েই থাকেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে ১৯৬৬ সালের ৯ জুন তিনি লেখেন, ‘তারা আমাকে খোকা বলে ডাকেন। মনে হয়, আজও আমি তাদের সেই ছোট্ট খোকাটি। পারলে আমাকে কোলে করেই শুয়ে থাকেন।’
একই বছরের ২৪ জুলাই জেলে বসেই বাবার চিঠি পান বঙ্গবন্ধু। তাতে পিতা তাঁকে সম্বোধন করেন ‘বাবা খোকা’ নামে। চিঠি পড়ে বঙ্গবন্ধুর মনে হতে থাকেÑ ‘বাবা-মায়ের কাছে আজও আমি খোকাই আছি। যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন আমাকে এই নামেই ডাকবেন। যেদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন আর কেউই এ স্নেহের নামে আমাকে ডাকবেন না।’
বঙ্গবন্ধু লিখতে থাকেন ‘আমার ৪৫ বছর বয়স। চুলেও পাক ধরেছে। পাঁচটি ছেলেমেয়ের বাবা আমি। তথাপি আজও আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে বোধ হয় সেই ছোট্ট খোকাটিই। এখনও মায়ের ও আব্বার গলা ধরে আদর করি, আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়।’ বারবার মা-বাবাকে স্মরণ করে মন খারাপ হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর। মায়ের সঙ্গে আর দেখা হবে কি না তা ভেবে অস্থির হয়ে ওঠেন। অস্থিরতা কাটাতে মনোযোগী হতে চেষ্টা করেন খবরের কাগজ আর বইয়ের পাতায়। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানে কাজ করেন। কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মা-বাবার কথা মুছতে পারেন না। কিছুই ভালো লাগে না তার। মনে মনে তখন স্মরণ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। শান্তি খোঁজেন তার কবিতায়। আপন মনে পড়তে থাকেন
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
জীবনসায়াহ্নে দেওয়া বহুল প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে বাবা শেখ লুৎফর রহমানও ছেলে মুজিব সম্পর্কে বলেন, ‘তাকে আমরা খোকাই বলি।’ কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে চীরকালের এই খোকা কেমন ছিলেন শৈশবে?
আগেই বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন ডানপিটে। ক্রীড়া ও সঙ্গীতপ্রেমী। গ্রামীণ প্রকৃতির আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা দস্যি ছেলে। একই সঙ্গে মানবসেবা ও পরোপকারে ব্রতী। যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ে জিতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। দেশ-বিদেশের খবর সম্পর্কে হালনাগাদ থাকতে পত্রিকায় চোখ রাখতেন নিয়মিত। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সব কাগজই পড়তাম।’
শুধু কি পত্রিকা পড়া? কিশোর বয়সেই মানবসেবার সব শাখায় সাবলীল বিচরণ শুরু হয় তার। স্কুলছাত্র থাকাকালেই আবদুল হামিদ মাস্টারের সঙ্গে মিলে গঠন করেন মুসলিম সেবা সমিতি। ওই সমিতির কাজই ছিল গরিব ছাত্রদের সাহায্য করা। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি (হামিদ মাস্টার) বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গীরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হতো তার সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতিরি ভার নেই এবং অনেকদিন পরিচালনা করি।’
কোনো পরিস্থিতিতেই তার হার না মানার একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে মেট্রিক পরীক্ষার আগের ঘটনা। ১৯৪১ সালে পরীক্ষায় বসার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘পরীক্ষার একদিন পূর্বে আমার ভীষণ জ্বর হলো এবং গলা ফুলে গেল। একশ চার ডিগ্রি জ্বর উঠেছে। আব্বা রাতভর আমার কাছে বসে রইলেন। গোপালগঞ্জ শহরের সব ডাক্তারই আনালেন। জ্বর পড়ছে না। আব্বা আমাকে পরীক্ষা দিতে নিষেধ করলেন। আমি বললাম, যা পারি শুয়ে শুয়ে দেব। আমার জন্য বিছানা দিতে বলেন। প্রথম দিনে বাংলা পরীক্ষা। সকালের পরীক্ষায় মাথাই তুলতে পারলাম না। তবুও কিছু কিছু লিখলাম। বিকালে জ্বর কম হলো। অন্য পরীক্ষা ভালোই হলো।’ এই অদম্য মানসিকতার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু তার জীবনের পরতে পরতে রেখেছেন। হয়েছেন বাঙালির মুক্তির দিশারি। জাতির পিতা। ঠাঁই করে নিয়েছেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের কাতারে। কিন্তু মা আর বাবার কাছে চিরকাল খোকা হয়েই থেকেছেন তিনি। বাবার বলা ‘সিনসিয়ারিটি অব পারপাস অ্যান্ড অনেস্টি অব পারপাস’ থাকলে জীবনে কখনও পরাজিত হবা না। আপ্তবাক্যটি জীবনভর খোকার মতোই মেনে চলেছেন বঙ্গবন্ধু। হয়ে উঠেছেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান। মা-বাবার আদরের খোকা হয়েই থেকেছেন আজীবন।

লেখক : সাংবাদিক