সর্বশেষ
প্রচ্ছদ / বাংলাদেশ / জাতীয় / ‘রাজনীতি গরিবের বউয়ের মতো হয়ে গেছে’

‘রাজনীতি গরিবের বউয়ের মতো হয়ে গেছে’

হাওর বাংলা ডেস্ক :  রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিতদের অবসরের পর রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের পথে এটিকে বাধা হিসেবে দেখছেন তিনি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেও চিন্তা-ভাবনা করতে বলেছেন তিনি।

শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে আবদুল হামিদ বলেন, “আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ (ভাবি)। রাজনীতিও হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে, বাধা নাই।”

ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে যুক্ত আবদুল হামিদ সমাবর্তনে তার লিখিত বক্তব্যের বাইরে গিয়ে একথা বলেন। এসময় সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারীরা হাসিতে ফেটে পড়েন।

কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার টানে তিনি বলেন, “আমি যদি বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের লেকচারার হইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব আমারে নেবেন না। বা কোনো হাসপাতালে গিয়া বলি, এতদিন রাজনীতি করছি, হাসপাতালে ডাক্তারি করতে দেন। বোঝেন অবস্থাটা কী হবে? এগুলো বললে হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না।

“যদি বলি এত বছর রাজনীতি করছি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর পদ দিতে পার। সেখানে আমাকে দিবে? কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, “সবাই… ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি ডাক্তারি পড়ি… ভিসি সাহেবও অবসরের পর রাজনীতি করবেন। যারা সরকারি চাকরি করেন… জজ সাহেব যারা আছেন ৬৭ বছর চাকরি করবেন। রিটায়ারের পর বলবেন, ‘আমিও রাজনীতিবিদ’। আর্মির জেনারেল হওয়া সেনাপ্রধান হওয়া, সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি রিটায়ার কইরা বলেন, ‘আমি রাজনীতি করবো।’ কোন রাখঢাক নাই। যার ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা তখনই রাজনীতি ঢোকে…

“চাকরি করে যা করার করছে। এরপর বলছে রাজনীতি করবো। আমার মনে হয় সকল রাজনৈতিক দলকে এটা চিন্তা করা উচিত। হ্যাঁ এক্সপার্টের দরকার আছে। অনেক সময় বলা হয় পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট। হ্যাঁ পেশাভিত্তিক করেন। এমবিবিএস পাস করে সরাসরি রাজনীতি করেন। কোনো অসুবিধা নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরিতে না ঢুকে সরাসরি রাজনীতিতে ঢোকেন।”

রাষ্ট্রপতি বলেন, “৫৯ বছর, ৬৫ বছর ৬৭ বছর পুলিশের ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করবেন। মনে মনে কই, রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়ে পাছার মধ্যে বাড়ি দিছো। তুমি আবার আমার লগে আইছো রাজনীতি করতে। কই যামু।”

“রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এই যে রাজনীতিবিদদের সমস্যা এই সমস্যার কারণও এটা। বিজনেসম্যানরা তো আছেই… শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার।”

ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির শিক্ষা নেওয়ার উপর জোর দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “এক্সপার্টের প্রয়োজন আছে। এক্সপারটাইজ হিসেবে তাদের মতামত নেন। তাদের কমিটি করে দেন, উপদেষ্টা করে দেন।

“ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে এটা যেন কেমন কেমন লাগে। যার জন্যেই আমার মনে হয় আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না।”

এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে কথা বলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আবদুল হামিদ।

“ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার আলো দেখছি। ছাত্র সমাজের বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই। যখন তফসিল হয়, দেখা যাবে অনেক ক্যালকুলেশন হবে। ভেজাল সৃষ্টি করে দিতে পারে। অনেকে অনেক স্বার্থে করতে পারে। কিন্তু সমস্ত ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করা উচিত না। এ ব্যাপারে তৎপর থাকতে হবে। যাতে কোনোভাবে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। যারা ব্যক্তি বা অন্য স্বার্থ দেখতে চায় এদেরকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কুফলও উঠে আসে রাষ্ট্রপতির কথায়।

“কলেজে পড়ার সময় আমরা প্রেমপত্র লিখছি। ভালো কোটেশন কিভাবে চিঠিতে দিলে সুন্দর হবে। এখন তো চিঠি লেখাই একেবারে নাই। এখনতো মেসেজ পাঠায়। ইংরেজিতে বাংলা লেখে। কী লেখে? ফেইসবুক-টেইসবুক এসব আমি বুঝি না। আমি ব্যাকডেটেড।

রসিকতা করে তিনি বলেন, “আপনারা যে প্রেমপত্রকে বিসর্জন দিছেন। প্রেমের সাহিত্য তো মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে যাচ্ছে। প্রেমপত্র লেখার চর্চাটা অন্তত রাখেন। তাহলে প্রেমপত্রে সাহিত্য বেঁচে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

“ছোটবাচ্চাদের মোবাইল দিয়ে বসায়া রাখে। এইটাও চিন্তা-ভাবনার বিষয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার কমানো প্রয়োজন।

“ট্রেনে-বাসে উঠলে পাশের যাত্রীকে বলতাম কোথায় যাবে। এখন কোনো কথাই নেই। বইয়াই মোবাইল টিপ দিয়া দেয়। তুই ব্যাটা জাহান্নামে যা, আমি আছি মোবাইল আছে। এই যে অবস্থা। আমার মনে হয় সামাজিক বন্ধন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।”

বিভিন্ন সময়ের মতো স্ত্রী রাশিদা খানমের সঙ্গে নিজের খুনসুটির কথাও তুলে ধরেন আবদুল হামিদ।

সমাবর্তনের লিখিত বক্তব্যে গুণগত মান সমুন্নত রেখে দেশের চাহিদা ও বিশ্বের জনশক্তি বাজারের কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর সম্প্রসারণ করার পক্ষে মত দেন রাষ্ট্রপতি।

তিনি বলেন, “অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, এ সংযোজন, বিয়োজন বা সম্প্রসারণ যাতে কোনো ব্যক্তি বা কতিপয় লোকের স্বার্থে না হয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে হয়।”

দেশের প্রয়োজনে এবং জাতীয় স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানান আবদুল হামিদ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্স লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত করছে কি না, তা ভেবে দেখতেও বলেন রাষ্ট্রপতি।

“ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্বাভাবিক লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে কি না তা ভাবতে হবে। আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের বৃহৎ স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা ভেবে দেখবেন। মনে রাখতে হবে, জনগণের অর্থেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। তাই তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।”

কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তনে রেজিস্ট্র্রেশন করেছেন ২১ হাজার ১১১জন গ্র্যাজুয়েট। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যা। কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৬টি স্বর্ণ পদক, ৮১জনকে পিএইচডি ও ২৭ জনকে এম ফিল ডিগ্রি দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আরও বক্তব্য দেন উপাচার্য মো. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, প্রো উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *